ঢাকায় বিপুল আয়োজন আর বড় বাজেটের জাতীয় সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির জন্ম- পরবর্তী কোনো সমাবেশ হলো ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একইসঙ্গে দলটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমাবেশ করে নিজেদের শক্তি আর জনসমর্থনের জানান দেয়ার একটি মহড়া হয়েছে। ঢাকাবাসীর দুর্ভোগের জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে করা এই সমাবেশের কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল রাজধানী। সারা দেশ থেকে লোকসমাগম করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের। ১০ হাজার বাস ভাড়া করে লোক আনা হয়েছে। চার জোড়া ট্রেন ভাড়া করা হয়েছিল সমাবেশে দলীয় নেতাকর্মীদের বহন করার জন্য। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের এই সমাবেশ ঘিরে দলটির প্রচার-প্রচারণা ছিল স্মরণকালে সবচেয়ে বড় আয়োজন। মাঠে প্রচারের পাশাপাশি অনলাইনে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরা বিরামহীন প্রচার চালিয়েছেন। এই প্রচার-প্রচারণা থেকে বুঝা যাচ্ছিল সমাবেশকে দলটির শক্তি প্রদর্শন আর দলীয় সমর্থনের একটি পোস্টারে পরিণত করতে চান তারা। আদতে শনিবারের সমাবেশটিও তাই হয়েছে। লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হয়েছিল সারা দেশ থেকে। বাসে, ট্রেনেসহ নানা যানে দূর-দূরান্তের মানুষ ঢাকায় আসেন। কেউ কেউ শুক্রবার রাতেই সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আসন নিয়েছিলেন। তাদের পদভারে আশপাশের সড়ক শুক্রবার রাত থেকেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ভোর থেকে দলটির নেতাকর্মীদের জনস্রোত নামে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অভিমুখে। বেলা দুইটায় আনুষ্ঠানিক সমাবেশ শুরু হলেও সকাল ১০টার আগে থেকেই শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। সমাবেশের দ্বিতীয় পর্বে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সমমনা অনেক দলের প্রতিনিধি বক্তব্য দেন। ’২৪- এর গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সবকটি’র প্রতিনিধি এই সমাবেশে অংশ নিলেও বিএনপি’র কোনো প্রতিনিধি অংশ নেননি এই সমাবেশে। জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিনা তাও স্পষ্ট নয়। এর আগে একই উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ যে জাতীয় সমাবেশ করেছিল সেখানেও বিএনপি’র কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় জামায়াতের শনিবারের সমাবেশেও বিএনপি’র কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে বিএনপি ছাড়া অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া অন্যান্য দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং বক্তব্য দেন। ওই সমাবেশে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং সংস্কার ও বিচারের জোরালো দাবি তুলেন সব দলের নেতৃবৃন্দ। জামায়াতের সমাবেশ থেকেও একই দাবি তোলা হয়েছে। জামায়াত এবং অন্যান্য দলের নেতারা তাদের বক্তব্যে পিআর এবং সংস্কারের দাবি তুলেছেন। গণহত্যার বিচারের দাবি জানিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশের পরই প্রশ্ন উঠেছিল বিএনপিকে বাদ দিয়ে কী ঐক্য গড়ার কাজ চলছে কিনা। জামায়াতের শনিবারের সমাবেশে এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে। ভোটের মাঠে ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার একটি জোর প্রক্রিয়া অনেকদিন থেকেই চলছে। এই প্রক্রিয়ায় নেপথ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছে জামায়াত। প্রকাশ্যে কাজ করছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। ইতিমধ্যে কয়েকটি ইসলামী দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে। এই আলোচনা অনেকদূর এগিয়েও গেছে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের পরপর দু’টি সমাবেশ ইসলামী দলগুলোর ঐক্য প্রক্রিয়ার বড় অগ্রগতি বলে ধরা হচ্ছে। এই সমাবেশ দু’টির মাধ্যমে নেতারা অভিন্ন দাবি ও বক্তব্য তুলে ধরেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম শক্তি বিএনপিকে আলাদা রেখে এই ঐক্য উদ্যোগকে রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। আসছে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। আসছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে এমন একটি আভাস মিলেছিল লন্ডন বৈঠকে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওই বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে একটি ইতিবাচক বার্তা আসায় দেশে একটা স্বস্তির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা দলগুলো এই বৈঠক এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেনি। বরং এসব দল এই বৈঠককে নেতিবাচক হিসেবে প্রচার করেছে। সরকারের সমালোচনা করেছে। সরকার প্রধানের সমালোচনা করেছে। এসব দল নির্বাচন নিয়ে এরপর থেকে নতুন নতুন দাবি জোরালো করে তুলেছে। তারা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন এবং সংস্কারের গুরুত্ব দিচ্ছে। নির্বাচনের আগে সংস্কার এবং গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান করার তাগাদা দিচ্ছে। কিন্তু সংস্কার এবং বিচারের এই প্রক্রিয়া যেই গতিতে এগোচ্ছে এভাবে এগোলে সামনে তা কতোদিনে দৃশ্যমান হবে তা কেউ বলতে পারছে না। এমন অবস্থায় আসছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের যে আলোচনা আছে তাতে এসব দলগুলোর আগ্রহ ও প্রস্তুতি এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। দাবির বহর নিয়ে মাঠে থাকা এসব দল যে কৌশল নিয়েছে তাকে নয়া মেরূকরণ হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বলা হচ্ছে জামায়াত কৌশলে নিজেদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করছে। নানা ইস্যু সামনে এনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে বিভ্রান্ত করছে। সমমনা দলগুলোর নীতিও প্রায় একই। এসব দল চাইছে আসছে নির্বাচনে তাদের বড় হিস্যা আদায় করে নেয়া। হিস্যা আদায়ের এই কৌশলে সামনের নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে বলেও কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। জামায়াতের শনিবারের সমাবেশে হেফাজতের নেতারাও অংশ নিয়েছেন। তাদের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন। শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচারের জন্য কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন। জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বাইরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে হত্যা, গুম ও নির্যাতনের ঘটনার বিচারের জন্য কোনো কোনো দলের নেতা জোরালো দাবি তুলেছেন।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্য দেয়ার সময় দুই দফা পড়ে যান জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান। সমাবেশ আয়োজনে দলটির যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ ছিল তাতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ডা. শফিক প্রথম দফা পড়ে যাওয়ার পর আবার উঠে দাঁড়ান বক্তব্য দেয়ার জন্য। পরে আবার যখন পড়ে যান তখন নেতারা তাকে সরিয়ে বসিয়ে দেন। এরপর তিনি বসেই তার বক্তব্য শেষ করেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, আমরা জাতীয় ঐক্যের বীজতলা আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে তৈরি করবো। যারা এখানে কথা বলেছেন তারা আমার মনের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আগামীর বাংলাদেশে আরেকটা লড়াই হবে বাংলাদেশে। এই লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে সেই লড়াইয়েও আমরা বিজয় লাভ করবো। শালিনতা রক্ষা করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি সব দলের প্রতি আহ্বান জানান। অসুস্থ হয়ে পড়ায় জামায়াত আমীর তার পুরো বক্তব্য শেষ করতে পারেননি। তাই সমাবেশ নিয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তাও মিলেনি সমাবেশের শেষ পর্বে।
তারপরও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, সকল গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, ‘জুলাই সনদ’ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন ও এক কোটিরও বেশি প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ এসব দাবি নিয়ে করা জামায়াতের এই সমাবেশ থেকে রাজনীতির নয়া মেরূকরণ স্পষ্ট হয়েছে। সমাবেশ থেকে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি’র বাইরে বড় জোট বা ফ্রন্ট গড়ে দলটিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই চেষ্টার অংশ হিসেবে ভোট পিছিয়ে দেয়ার কৌশল নেয়া হলে দেশে নতুন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক মেরূকরণ নিয়ে বিএনপি এখনো নেতিবাচক কোনো অবস্থানে যায়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব দলের সঙ্গে বসে একটি সমঝোতায় আসার চেষ্টা করছে। দলটির তরফে বলা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য গড়তে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ার মানসিকতা তাদের রয়েছে। জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণা নিয়েও দলটি ইতিবাচক। জুলাই মাসের মধ্যেই তারা এই দু’টি বিষয় নিষ্পত্তি করতে চাইছেন। এই অবস্থায় জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দলের ঐক্য প্রক্রিয়া এবং বিএনপিকে বাদ দিয়ে ফ্রন্ট গড়ার প্রক্রিয়া জাতীয় ঐক্যেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পুরনো রাজনৈতিক দল হলেও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে এই প্রথমবার সমাবেশ করলো। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াত এই সমাবেশ করার সুযোগ পেয়েছে। আওয়ামী লীগের সময়ে তাদের এ ধরনের সভা-সমাবেশ করার অধিকার দেয়া হয়নি। দলটির নেতাকর্মীদের সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। এই অবস্থার অবসান হয় ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর। বলা হচ্ছে অভ্যুত্থানের পর জামায়াত ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো সময় অতিবাহিত করছে। তাদের উপর কোনো ধরনের রাজনৈতিক চাপ নেই। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। অবাধে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে। নির্বাচনী প্রস্তুতি নেয়া সহজ হয়েছে। এই অবস্থায় শনিবারের সমাবেশকে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবেই দেখছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা।