দেশ কি আবারো গভীর সংকটের দ্বারপ্রান্তে? ‘মব’ ভায়োলেন্স রীতিমতো নৈরাজ্যে রূপ নিয়েছে? সহিংসতা, হত্যা, হামলা-মামলা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি-দখলবাজি কিছুতেই থামছে না। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে পিটিয়ে হত্যার তালিকা। পুরনো ঢাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যার পর উন্মত্ত আচরণ দেশের মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে। জনজীবন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। থানায় আগুন দেয়ার হুমকি, থানা আক্রমণ করে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা পুলিশকেও ভীত করে তুলেছে। অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগের নেই কোনো সুখবর। বরং ট্রাম্পের শুল্কঝড় ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। ওয়াশিংটনে দরকষাকষির বৈঠক কোনো সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়েছে। বরং মার্কিন ক্রেতারা কিছু পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। সীমান্ত দিয়ে ভারতের পুশইন প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। থামছে না মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা প্রবেশ। মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার ৩৪ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দেশের জন্য নতুন করে ভিন্ন বার্তা দেয়। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে জঙ্গিবাদের বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। জুলাই সনদ-সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের অন্তহীন সংলাপ চলছেই। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে কবে পৌঁছানো যাবে, তাই এখনো স্পষ্ট নয়। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে নির্বাচনের মঞ্চ কবে তৈরি হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। ডেঙ্গুর বিস্তার ক্রমে ভয়াবহ হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও বড় কর্তাদের নড়াচড়া এখনো নজরে আসছে না। সব মিলিয়ে এক অনিশ্চয়তার মেঘ যেন দেশের মানুষকে ঘিরে রেখেছে। কোথাও কোনো সুখবর নেই। দেশ যেন এক অজানা গন্তব্যের পথে হাঁটছে।
আগামী ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের এক বছর পূর্তি। কোটা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দিয়ে শুরু, একদফার গণ-অভ্যুত্থানে যার সফল পরিণতি। নেতৃত্বে ছিলেন তরুণরা। দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ গণতন্ত্রের জন্য রাজপথে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও গণ-অভ্যুত্থানের সক্রিয় অংশীদার। হত্যা, গুম, হামলা, মামলায় জর্জরিত হয়ে তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। রংপুরের আবু সাঈদ, ঢাকার মুগ্ধ, শিশু রিয়াসহ শহীদদের তালিকায় হাজারো নাম। হাত-পা হারানো, গুলিতে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া তরুণ যুবকদের নিয়ে এখনো খবর তৈরি হয়। প্রফেসর ইউনূস ৮ই আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার এক বছর পূর্ণ করবেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এক বছরেও দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেননি। শান্তি তো দূরের বিষয়, জনজীবনে স্বস্তিটুকু পর্যন্ত নেই। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, প্রফেসর ইউনূস গভীর সমুদ্রে দিক হারিয়ে ফেলা জাহাজের এক নিঃসঙ্গ নাবিক। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সরকারের মধ্যে কুম্ভকর্ণের সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে। সরকারের মধ্যে অদ্ভুত মানসিকতা দেখতে পাচ্ছি, যেটাকে বলা যায় নিউফর্ম অব কুম্ভকর্ণ সিনড্রোম- শোনা হচ্ছে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া নেই। যদিও এসব কথা বলায় সরকার রাগ করতে পারে।’ রাজনীতিতে বিভাজন তীব্র হয়েছে। হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি বেড়েছে। চাঁদাবাজি-দখলের অভিযোগের তীর বিএনপি’র দিকেই ছুটে চলেছে। শত চেষ্টা করেও কর্মীদের থামাতে পারছে না দলের হাইকমান্ড। এখন দলের তৃণমূল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সোহাগ হত্যার পর পানি ঘোলা করে মাছ শিকার করতে চাইছে কোনো কোনো দল, এমন কথাও উঠেছে। হত্যাকাণ্ডকে ইস্যুতে পরিণত করে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার তৎপরতা লক্ষ্য করার মতো। উদ্দেশ্য, ভোটের অঙ্কে বিএনপিকে পিছিয়ে দেয়া।
সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে ‘মব ভায়োলেন্স।’ গত এক বছরে মব সহিংসতায় নিহতের সংখ্যায় ১৮০ ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের কোনো সরকারের আমলে মব ভায়োলেন্সে এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কুমিল্লার মুরাদনগরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে ছেলেমেয়েসহ মাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এক সপ্তাহ পার না হতেই রাজধানীর মিটফোর্ডে সংঘটিত হয় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। ঘটনার ভয়াবহতা এক পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য থেকেই উপলব্ধি করা যাবে। ডিএমপি’র এক অতিরিক্ত কমিশনার সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ‘এমন বীভৎসতা আগে দেখিনি। রক্তাক্ত লাশের ওপর যা হয়েছে, তা অবর্ণনীয়। এই আচরণ চিন্তার বাইরে।’ গত ১১ই জুলাই এই ঘটনা অনেক গণমাধ্যমে প্রধান শিরোনাম হয়। ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ১২ই জুলাই সংবাদপত্রের শিরোনাম: খুলনায় আরেক নৃশংসতা, রামদা হাতে আলোচনায় এসে দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন। বাড়ির সামনে ৯ গুলির পর রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। আইন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, মব সন্ত্রাসে আরও যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কী হবে? দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করতে হয় মুরাদনগরের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পিটিয়ে ছেলেমেয়েসহ মাকে নৃশংস হত্যার ঘটনা কী এর বাইরে থাকবে? আলোচিত আছিয়া ধর্ষণের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়েছে। বাদবাকি ধর্ষণের মামলায় অগ্রগতির কোনো খবর জানা যায় না। অথচ এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৮১ নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জেলা, থানা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে নতুন নতুন মাফিয়া তৈরি হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ত্বকী হত্যার ১৪৮ মাস উপলক্ষে সম্প্রতি শহরে অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ‘ত্বকী হত্যায় অভিযুক্ত শামীম ওসমান পালিয়ে গেলেও নারায়ণগঞ্জে নতুন করে গডফাদার তৈরি হচ্ছে।’
সনদ ও সংস্কার নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয় কিনা, সে আশঙ্কাও করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ শুরু হয়েছে গত ২৫শে মার্চ। দীর্ঘ চার মাসেও সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। সংবিধান, নির্বাচন পদ্ধতির অনেক বিষয়েই কয়েকটি দলের অবস্থান বিপরীতমুখী। উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ নিয়ে বিশেষ করে পিআর পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ স্পষ্ট। বর্তমানে রাজনীতির মাঠের প্রধান দল বিএনপি সাফ জানিয়েছে, কোনোমতেই পিআর পদ্ধতি মানবে না তারা। আরেক বড় দল জামায়াতে ইসলামী, নবগঠিত এনসিপি এবং কয়েকটি ইসলামী দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে অটল মনোভাব দেখাচ্ছে। জুলাই সনদ ঘোষণার জন্য কয়েক দফা তারিখ ঘোষণা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। জুলাই মাস অতিবাহিত হওয়ার পথে। বহুল আলোচিত ও উচ্চারিত জুলাই সনদ কবে নাগাদ ঘোষণা হবে, তা এক বিরাট জিজ্ঞাসা। নির্বাচনের সময় নিয়েও বিতর্ক জারি রয়েছে। বিএনপি ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচনের দাবি মাঝেমধ্যেই পুনর্ব্যক্ত করছে। অন্যদিকে এনসিপি বিচার ও সংস্কার শেষে নির্বাচনের দাবি অব্যাহত রেখেছে। জামায়াতসহ আরও কয়েকটি দল একই সুরে কথা বলছে।
সংস্কার, সনদ ও নির্বাচনের আলোচনার ডামাডোলের মধ্যে একটি জরিপ রাজনীতি নিয়ে হতাশার চিত্র তুলে ধরেছে। জরিপে বলা হয়েছে তরুণরা নির্বাচনে ভোট দিতে চান। অথচ ৮৩ শতাংশ তরুণ রাজনীতিতে যোগ দিতে চান না। কারণ হিসেবে তারা রাজনীতিতে সহিংসতা, রাজনীতিতে দুর্নীতি ও নৈতিকতার ঘাটতির কথা বলেছেন। সানেম (সাউথ এশিয়ান অন ইকোনমিক মডেলিং) ও অ্যাকশন এইড এই জরিপ পরিচালনা করে। জুলাই অভ্যুত্থানে লাখ লাখ তরুণ রাজপথে নেমে এসেছিলেন। পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর বুলেট উপেক্ষা করেছেন। অভ্যুত্থানের কারণ শেষ পর্যন্ত রাজনীতিই ছিল। অথচ অভ্যুত্থান শেষে তরুণরা তাদের জায়গায় ফিরে গেছেন। রাজনীতি নিয়ে তরুণদের বক্তব্য রাজনীতির দেউলিয়াত্ব তুলে ধরেছে। একই সঙ্গে আগামীদিনের রাজনীতির জন্য অশনি সংকেতও বটে।
রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলার বাইরে অন্যদিকের চিত্রও হতাশা ছড়াচ্ছে। থামছে না পুশইন। গত ২৭শে মে প্রথম পুশইন শুরু করে ভারত। সব মিলিয়ে ২২টি সীমান্ত দিয়ে এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি পুশইন করা হয়েছে। ভারতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের বড় মাত্রায় পুশইনের নজির নিকট অতীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার নিন্দা ও উদ্বেগ আমলে নিচ্ছে না ভারত। বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনাও থামছে না। সর্বশেষ গত এক সপ্তাহে তিন সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
শিক্ষাঙ্গনেও বিরাজ করছে অস্থিরতা। স্কুল- কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে সড়কে নামছেন শিক্ষার্থীরা। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অফিসে এক শিক্ষকের পদোন্নতির ভাইভা হওয়ার কথা। ভিডিওতে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন ছাত্র ওই শিক্ষককে পদোন্নতি দেয়া যাবে না বলে চিৎকার করছেন। একপর্যায়ে একজন ছাত্র উপাচার্যকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি। আপনাকে আমরা বসিয়েছি। আপনি আমাদের কথা শুনতে বাধ্য।’ এখানে স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের আগে বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগকর্তা।’ এরপর তিনি একই কথার পুনরুল্লেখ করেছিলেন, ‘ছাত্ররা তাদের (উপদেষ্টা পরিষদ) প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। তারা যখন বলবে, তখন তারা চলে যাবে।’
এত কিছুর ভিড়ে ডেঙ্গুর ক্রমাগত বিস্তার কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। অথবা তারা বিষয়টিকে আমলে নেয়ার মতো মনে করছেন না। মাসের প্রথম সপ্তাহের খবর, ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৫৪ ব্যক্তি। তখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সংবাদপত্রের খবর, ডেঙ্গু, করোনা পরীক্ষায় বাড়তি অর্থ আদায় করছে রাজধানীর অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং হাসপাতাল পরিদর্শনে যান এবং বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। বর্তমানে একজন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আছেন। কিন্তু শুরু থেকেই কোনো কিছুতেই তার কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।
প্রফেসর ইউনূস কি সংকটের বেড়াজাল অতিক্রম করতে পারবেন? দেশকে নির্বাচনমুখী করে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিতে নোবেল বিজয়ী সফল হবেন কিনা সময়ই তা বলে দেবে।
লেখক: কলাম লেখক