আ ন্ত র্জা তি ক

আরব বিশ্বের সামনে কঠিন প্রশ্ন

মোহাম্মদ আবুল হোসেন | আন্তর্জাতিক
আগস্ট ২, ২০২৫
আরব বিশ্বের সামনে কঠিন প্রশ্ন

আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে সংঘর্ষ কেবল প্রাণহানি, আহত বা নিখোঁজ মানুষই তৈরি করে না, বরং এসবের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর। এই বিপর্যয় ঠেকানোর মূল চাবিকাঠি হলো- রাষ্ট্রগুলো কী ধরনের কূটনীতি গ্রহণ করছে এবং সেটি কতো দূরদর্শী। লেনদেনভিত্তিক কূটনীতি অর্থাৎ ‘ডিল-কেন্দ্রিক’ কূটনীতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন, ন্যায্যতা বা মানবিক মূল্যবোধের চেয়ে তাৎক্ষণিক লাভ ও চুক্তিকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্সির সময় থেকে এই ধারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এবং আজও তা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রভাব বিস্তার করছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেও এই কৌশল অনুপ্রবেশ করেছে, যার ফলে অভ্যন্তরীণভাবে জাতীয়তাবাদ, জাতিবিদ্বেষ এবং মানবকেন্দ্রিকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যা আবার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অস্থিরতাকে উস্কে দিচ্ছে।


লেনদেনভিত্তিক কূটনীতি অনেক সময় স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন হয়। যেমন, ট্রাম্পের ঘোষিত পারস্পরিক শুল্ক নীতির ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা, যেখানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্যে যে স্থায়িত্ব এসেছিল, তা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে যে অসন্তোষ বিরাজ করছে, তার প্রতিফলন সবচেয়ে তীব্রভাবে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, এই অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ২০১০ সালের ৪ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৪ শতাংশে। শুধু গত বছরেই প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের নিচে চলে গেছে। এই দারিদ্র্য বৃদ্ধিকে কেবল ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা, কোভিড-১৯, বা ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সংকটে দায়ী করা যাবে না। কারণ এসব দুর্যোগ বাকি বিশ্বেও আঘাত হেনেছে, অথচ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গড় দারিদ্র্যের হার ৯.৯ শতাংশ, যেখানে ২০১০ সালে তা ছিল ২১ শতাংশ। তেল ও জ্বালানি মূল্যের ওঠানামাও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলে না, কারণ সেখানে রয়েছে রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারক- উভয়ই। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দুর্দশার মূল কারণ দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ও রাষ্ট্রীয় ভঙ্গুরতা। এই প্রেক্ষাপটে আরব দেশগুলোর সামনে প্রশ্ন ওঠে- তারা কি লেনদেনকেন্দ্রিক কূটনীতি গ্রহণ করবে, নীতিনির্ভর পথ ধরবে, নাকি দু’টির মধ্যে কোনো ভারসাম্য খুঁজে নেবে?


সম্প্রতি ইসরাইলের ইরানে আঘাত হানা এই বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ইসরাইল এসব হামলাকে প্রতিরোধমূলক বলে দাবি করলেও তার ভিত্তি ৩০ বছর আগের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর (তৎকালীন এমপি) দেয়া বক্তব্য- ‘ইরান কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলতে পারে।’ যদিও আজ পর্যন্ত এর কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মেলেনি। ২০২৫ সালের মার্চে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড মার্কিন সিনেটে সাক্ষ্য দেন যে, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির কোনো সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থাও (আইএইএ) এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত হয়ে জানায়, ইরানের গোপন অস্ত্র কর্মসূচির কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও ইসরাইলের এই হামলার পক্ষে দাঁড়ান জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎসে এবং জি-৭ নেতারা। যুক্তরাষ্ট্রও পরবর্তীতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়। তবে দুইদিন পরই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, যা এখনো টিকে আছে।
প্রক্সি যুদ্ধ অনেক সময় শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে, কিন্তু নিরীহ জনগণ তার চরম মূল্য দেয়। ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধ উভয় দেশকেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এরপর ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট ইরাকে হামলা করে, মিথ্যা অস্ত্রের অভিযোগে। এই ধরনের যুদ্ধ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমনকি তারা সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও। গাজার যুদ্ধ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মিশর ও জর্ডান যথাক্রমে ১৯৭৯ ও ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করলেও, বর্তমান সংঘর্ষে তাদের পর্যটন খাতে ধস নেমেছে, জ্বালানি নিরাপত্তা কমেছে, পরিবহন ব্যয় বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। সম্প্রতি ইরানে হামলার পরপরই এই দেশগুলোতে পর্যটন বাতিলের হার বেড়ে যায়, যা রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘাটতি, জনঋণ এবং বেকারত্ব বাড়িয়ে দেশগুলোর স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।


এই সংঘাতের ঝুঁকি কেবল উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে- জ্বালানি ও শিপিং খরচ বাড়তে পারে, মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার চড়তে পারে এবং বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়তে পারে। এর ফলে স্টক মার্কেটে অস্থিরতা, মুদ্রা বিনিময় হার হ্রাস এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। তারপরও কিছু পশ্চিমা নেতা যুদ্ধকে অর্থনৈতিক চাঙ্গা করার উপায় হিসেবে দেখছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার সম্প্রতি পার্লামেন্টে বলেন, প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ফিরে আসবে। যদিও যুদ্ধকালীন শিল্পসমূহ এতে লাভবান হতে পারে, কিন্তু মানুষের জীবন, জীবিকা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়, তা কখনোই এই স্বল্পমেয়াদি লাভের সমান হতে পারে না।
২০২০ সালে ইসরাইল সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যা মূলত ছিল একটি লেনদেনকেন্দ্রিক কূটনৈতিক উদ্যোগ। তবে এই উদ্যোগের মাধ্যমে ইসরাইল তার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য- অধিকৃত ভূখণ্ডে নিয়ন্ত্রণ ও সম্ভবত ভবিষ্যতে তা সংযুক্ত করা- বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে আরব দেশগুলো শিক্ষা নিতে পারে- তারা নীতিবর্জিত না হয়ে বরং কৌশলগতভাবে স্বল্পমেয়াদি চুক্তিকে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করতে পারে। সৌদি আরব এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা এখনো আবরাহাম চুক্তিতে যোগ দেয়নি, বরং তাদের অবস্থান হলো- ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগে অবশ্যই ১৯৬৭ সালের সীমারেখায় একটি সার্বভৌম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অপরিবর্তনীয় ও বিশ্বাসযোগ্য অগ্রগতি থাকতে হবে। আবারো আরব দেশগুলো এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ কেবল প্রাণহানি ও ধ্বংসই আনে না, বরং অর্থনীতিকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দেয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্প্রতি এক আরব দেশের স্থিতিশীলতা কর্মসূচিতে সতর্ক করে বলেছে, দারিদ্র্য ও বেকারত্বজনিত গণ-প্রতিবাদ ও সহিংসতা এই উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। তাই আরব রাষ্ট্রগুলোর উচিত- একতাবদ্ধ হয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করা, যা স্বল্পমেয়াদি বাস্তববাদী চুক্তি ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও সমৃদ্ধির নীতিগত লক্ষ্যকে একসূত্রে গাঁথতে পারে। এখানে কেবল আরব বিশ্ব নয়, গোটা পৃথিবীর ভবিষ্যতই নির্ভর করছে। যদি তারা ভুল সিদ্ধান্ত নেয় কিংবা নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে তার মূল্য বিশ্বকেই দিতে হবে।


যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন?
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দুর্নীতির মামলার বিচার চলাকালে এক অপ্রত্যাশিত এবং কূটনৈতিকভাবে বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলস্থ রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি সরাসরি তেল আবিব জেলা আদালতে নেতানিয়াহুর বিচার কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন- যা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ ঘটনাকে নিছক কৌতূহল নয় বরং একেবারে ‘বিবি-ঘেঁষা ষড়যন্ত্র’ প্রচারণার অংশ বলেই চিহ্নিত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতি ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার পরোক্ষ অবস্থান ইসরাইলের বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার জন্য এক গুরুতর হুমকি। রাষ্ট্রদূতের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি  দাঁড়িয়ে আছেন নেতানিয়াহুর পাশে। অনেকেই একে বিচারের প্রহসনে রূপ দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন। যদি হাকাবি মুখোশ পরে থাকতেন, তবে এই দৃশ্য ২০২০ সালে নেতানিয়াহুর বিচার শুরুর সময়ের সেই বিখ্যাত ছবিকে মনে করিয়ে দিতো- যেখানে প্রধানমন্ত্রী মুখোশধারী মন্ত্রীদের নিয়ে বিচার বিভাগকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।


মাফিয়া স্টাইল কূটনীতি?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলমান বিচার বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই অবস্থান রাষ্ট্রদূতের আচরণেও প্রতিফলিত হয়েছে। ট্রাম্প যেন নেতানিয়াহুর ‘গডফাদার’ হয়ে উঠেছেন। রাষ্ট্রদূতের এই সফরের বার্তা ছিল সরাসরি এবং হুমকিমূলক- যে কেউ নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে চাইবে, তার ওপর চাপ, নিষেধাজ্ঞা, এমনকি বাণিজ্য যুদ্ধও চাপিয়ে দেয়া হতে পারে।
ব্রাজিলে ঘটছে একই রকম ঘটনা। সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর বিচার প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প সেখানে ৫০ ভাগ শুল্ক বসানোর ঘোষণা দিয়েছেন। জবাবে ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ব্রাজিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং আমাদের বিচার ব্যবস্থার ওপর কোনো নজরদারি বরদাশত করা হবে না। 
কিন্তু ইসরাইলে কে ট্রাম্পকে থামাবে? প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ? না কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদোন সা’আর? বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহু-ঘেঁষা দক্ষিণপন্থিদের বিচারবিরোধী যুদ্ধ এখন আন্তর্জাতিক রূপ পাচ্ছে। এই ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, নেতানিয়াহুর বিচার প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ার পথে। ট্রাম্পের বিচার বাতিলের আহ্বান যেন চূড়ান্ত বার্তা। এখন প্রশ্ন হলো- এই রাজনৈতিক নাটকের শেষ কোথায়?
ইসরাইলের জন্য এটি এক অপমানজনক অধ্যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক কূটনৈতিক আচরণ। নেতানিয়াহুর বিচারের নামে যেভাবে বিদেশি হস্তক্ষেপ ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর