যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নীতি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ও সম্ভাব্য মিত্রদের রাশিয়া ও চীনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এরই মধ্যে এর জোয়ার দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে শক্তিশালী করতে গিয়ে শুল্ক ও বাণিজ্য ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের শাস্তি দিচ্ছেন। সঠিক হোক বা বেঠিক হোক, যেকোনোভাবেই তিনি বিশ্বের সব দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে নেয়ার জন্য ব্যবহার করছেন এই নীতি। এর ফলে ভারত, রাশিয়া, চীন স্বার্থের প্রয়োজনে অভিন্ন অবস্থানে চলে আসছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন। এতদিন ভারত ও চীনের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক এখন মধুরতম হয়ে ওঠার সমূহ ইঙ্গিত মিলছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে তথা ট্রাম্পের পাল্টা হিসেবে এশিয়ায় একটি ক্ষমতার, রাজনীতির নতুন অক্ষ গড়ে উঠতে পারে। ট্রাম্পের নীতির ফলে বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতিতে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তিনি সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে বেছে নিয়েছেন শুল্ক ও বাণিজ্যযুদ্ধকে। কিন্তু তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা। তিনি এটা করতে গিয়ে দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে তিনি বা যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছেন, ঠিক তার উল্টোটা গাজার ক্ষেত্রে। সেখানে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। দুর্ভিক্ষে শিশুসহ মানুষ মারা যাচ্ছে। খাদ্য সংগ্রহ করতে যাওয়া মানুষের ওপর সরাসরি গুলি করে হত্যালীলায় মেতে উঠেছে ইসরাইল। তবু সেই ইসরাইলকেই তিনি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আরেকটু এগিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। অবশ্য, এটি হয়তো কিছুটা বাড়িয়ে বলা। রসিকতা করে বলা হয়, ব্রাজিল ‘ভবিষ্যতের দেশ’ এবং ভবিষ্যৎ হয়েই থেকে যাবে। তেমনি ব্রিকস হয়তো ‘ভবিষ্যতের জোট’ হিসেবেই থেকে যাবে। ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে এত পার্থক্য আছে যে, তারা কখনো ন্যাটো বা ওয়ারশ চুক্তির মতো দৃঢ় জোট গঠন করতে পারবে না। তবুও এই গ্রুপের সম্ভাব্য অংশীদার ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত’কে চীন ও রাশিয়ার দিকে ঠেলে দেয়া এক কৌশলগত ভুল। জুলিয়াস সিজার ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি দিয়ে রোমান শক্তি বাড়িয়েছিলেন। ট্রাম্প ঠিক উল্টো পথে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি কমাচ্ছেন- বন্ধুদের শত্রুর সঙ্গে এক করে দিচ্ছেন। তার অস্থির শুল্কনীতির সবচেয়ে বড় শিকার ভারত। গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি বিশ্বের জনবহুল দেশ এবং বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। এর অর্ধেক অর্থাৎ শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক শাস্তি দেয়া হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে নেয়ার অপরাধের জন্য। বাকি অর্ধেক বা ২৫ ভাগ রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের বড় ক্রেতা হয়ে ওঠার কারণে।
২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পর শুরু হয়েছে রাশিয়ার তেল, গ্যাস অনেক কম দামে কেনাবেচা। ভারত সেই সুযোগ লুফে নিয়েছে। এ পথ থেকে ভারতকে ফিরাতে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু তারা তা আমলে নেয়নি। ফলে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ ভাগ শুল্ক বাড়িয়ে শতকরা ৫০ ভাগে উন্নীত করেছেন ট্রাম্প। এতে ভারতের নেতারা স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্ত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বহু দশক ধরে ভারতকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে কাছে টানার চেষ্টা করেছে। ভারত তো কোয়াডেরও অংশ। এই কোয়াডে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানও আছে। চীনকে মোকাবিলার জন্য গঠিত হয় কোয়াড। ট্রাম্প নিজেও মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং ২০১৯ সালে হিউস্টনের এক জনসভায় একসঙ্গে হাজির হন। এমনকি ভারতে জাতীয় নির্বাচনের আগে মোদিকে সমর্থন দেন ট্রাম্প। বাইডেন প্রশাসন আসলে ভারতকে উৎসাহ দিয়েছিল রাশিয়া থেকে কম দামে তেল কিনতে, যাতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমে। অথচ এখন ভারতকে মস্কোর সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য শাস্তি দেয়া হচ্ছে। পক্ষান্তরে রাশিয়ার কাছ থেকে আরও বেশি তেল কিনছে চীন। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে যখন ট্রাম্প ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে কাছে টেনেছেন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে দুপুরের খাবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং পাকিস্তানের সামান্য তেলের মজুত উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বসে ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন অসিম মুনির। তার বিরুদ্ধে ট্রাম্প কিছু বলেননি। এই পাকিস্তানের ওপর মার্কিন শুল্কহার মাত্র ১৯ শতাংশ। এখানে লক্ষণীয় পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের সঙ্গে অনেক বেশি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। এখন ভারতের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের শুল্ক আক্রমণ উল্টো ফল দিচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করছে না ভারত। এক্সে দেয়া এক পোস্টে মোদি লিখেছেন, তিনি ‘বন্ধু প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে খুব ভালো এবং বিস্তারিত আলাপ’ করেছেন। এই আলাপ ‘ভারত-রাশিয়া বিশেষ ও সুবিধাজনক কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।’
তিনি আরও জানান, পুতিন এ বছরে আরও পরে প্রথমবারের মতো ইউক্রেন আক্রমণের পর ভারত সফরে আসবেন। এদিকে মোদি এ মাসের শেষ দিকে সাত বছরের মধ্যে প্রথমবার চীন সফরে যাচ্ছেন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের বৈঠকে যোগ দিতে। তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ ও আধিপত্যের লড়াইয়ের জবাবে ভারত, চীন, রাশিয়া একজোট হচ্ছে! ভারতের ঘোর প্রতিপক্ষ চীন। আঞ্চলিক মেগা পাওয়ার হিসেবে চীনের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতা সর্বজনবিদিত। সেই চীন সফরে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। বিষয়টা অবাক হওয়ার মতো না! এর মধ্যদিয়ে যে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে তা হয়তো প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বুঝতে পারছেন না অথবা বুঝেও তিনি নিজের ভাবনার বৃত্তে আটকে আছেন। পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার পাল্টা হিসেবে তৈরি হয়েছে রাশিয়া-চীন নেতৃত্বাধীন এই সংগঠন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন। ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, ‘ট্রাম্পের শুল্ক আঘাত যখন জোরদার হচ্ছে, তখন ব্রিকস জোট শক্তি সঞ্চয় করছে এবং প্রতিরোধের ঝড় তুলছে। ট্রাম্পের জন্য ব্রিকসের পাল্টা আঘাত আসতে পারে।’
আরও একটু বিস্তৃত দৃষ্টি দেয়া যাক। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প মন্তব্য করেন ‘ব্রিকস মৃত’। তিনি ইঙ্গিত করেন ব্রিকস নামের জোটের দিকে। এই জোট মূলত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত। এখন এতে যুক্ত হয়েছে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ গ্লোবাল সাউথের আরও কয়েকটি অংশীদার দেশ। কিন্তু কয়েক মাসে ট্রাম্প নিজেই হয়ে উঠেছেন এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের সেরা একজন প্রচারক। ২০০৯ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্ররোচনায় এই জোট তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী আমেরিকা নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে। ট্রাম্প যেন ইচ্ছাকৃতভাবে এই গ্রুপে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অংশীদারদের বিরূপ করে তুলছেন। ব্রাজিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। তাদের ওপরও ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এর বড় কারণ হলো ব্রাজিলের বিচার বিভাগকে চাপ দিয়ে ট্রাম্পের ডানপন্থি বন্ধু, সাবেক প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারোর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করানো। একটি দেশের আদালত সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোকে অভিযুক্ত করেছে। তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে। বলসোনারো অভিযুক্ত হন ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি ব্রাজিলে এক দাঙ্গা উস্কে দেয়ার অভিযোগে। কিন্তু তার মামলা প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিচ্ছেন ট্রাম্প। এটা কোন নৈতিকতা থেকে করা যায়! এটা তো অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ। কোনো আইন এটা সমর্থন করে না। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় তিনি এটা করতে পারতেন। কিন্তু সরাসরি নিজেই তার বন্ধু বলসোনারোকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। বিশ্ব রাজনীতিতে এটা নজিরবিহীন। ট্রাম্প প্রশাসন এরপর ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের যে বিচারপতি এই মামলার তদন্ত পরিচালনা করছেন, তার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কিন্তু নতি স্বীকার না করে ব্রাজিলের জ্বলন্ত মেজাজের বামপন্থি প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণে নেমেছেন। তিনি পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ফোনালাপ করেছেন কীভাবে ব্রিকস জোটকে শক্তিশালী করা যায় এবং ট্রাম্পের হুমকি থেকে বহুপক্ষীয় বিষয়গুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ এতেও ইঙ্গিত মেলে ভারত, চীন ও রাশিয়া একজোট হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও ট্রাম্পের দ্বন্দ্ব চলমান। এই দ্বন্দ্বের শুরু হয় ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা’ নামে এক ভুয়া অভিযোগ নিয়ে। ট্রাম্প বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের গণহত্যা করা হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর এই গণতান্ত্রিক দেশে ট্রাম্পের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার মে মাসের হোয়াইট হাউস বৈঠক হয়। সেই বৈঠক তার মেয়াদের দ্বিতীয় সবচেয়ে বিতর্কিত বৈঠক ছিল। প্রথম এমন উত্তেজনাপূর্ণ ও বিতর্কিত বৈঠক হয়েছিল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে। ট্রাম্প তার অতিথি সিরিল রামাফোসাকে ২০১২ সালের একটি ভিডিও দেখিয়ে বিস্মিত করেন। তাতে কৃষ্ণাঙ্গ জনতা ‘কিল দ্য বোয়ার’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল। যদিও সেই উগ্রবাদী নেতাকে পরবর্তীতে রামাফোসার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। ট্রাম্প দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করেন। প্রায় ৫০ জন আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ ‘শরণার্থী’কে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করেন। সম্প্রতি তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। সর্বোচ্চ হারের মধ্যে এই শুল্ক আফ্রিকায় অন্যতম। এতে অন্তত ৩০,০০০ কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এভাবে আফ্রিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং ধনী দেশগুলোর একটির সঙ্গে এমন আচরণ করা মোটেও কৌশলগত নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন, তবে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থানে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- দক্ষিণ আফ্রিকায় পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ খনিজ মজুত আছে। এর মধ্যে রয়েছে বিরল মাটির উপাদান বা রেয়ার আর্থ। এটা হলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে নরম অবস্থান নিয়েছে এবং গাজায় ইসরাইলের তুলনামূলকভাবে যৌক্তিক অভিযানের বিরোধিতা করেছে।
এ প্রসঙ্গে ১৪ই আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যে আচরণ করেছেন, সেই ঘটনা থেকে বাণিজ্যযুদ্ধের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে আঁচ করা যায়। সেটা হলো উদীয়মান কোনো দেশকে আটকে দেয়া। একসময় জাপানের বিরুদ্ধে একই অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। মুদ্রা কারসাজি থেকে শুরু করে নানাভাবে জাপানের উত্থান তারা ঠেকিয়ে দিয়েছে। এরপর বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হিসেবে চীনের উত্থান ঠেকাতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। এত দিন চীনকে ঠেকানোর কৌশলের অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে খাতির রাখলেও শুল্ক ও ভূরাজনৈতিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত কদর্যভাবে ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ভূ-অর্থনীতির প্রভাব ভূরাজনীতিতেও পড়বে। চীন ও ভারতের মধ্যে আস্থার ঘাটতি আছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, ভারত ও চীনে ২৮০ কোটির উপরে মানুষের বসবাস। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দ্রুত, প্রযুক্তিতেও তারা শীর্ষ পর্যায়ে; বিশ্বমানের বিজ্ঞানী, মহাকাশ কর্মসূচি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে অগ্রগতি- সব মিলিয়ে তাদের সম্পর্ক প্রকৃত অর্থে বহুমেরুকেন্দ্রিক ও বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থা গড়তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক জেফরি স্যাক্স সম্প্রতি হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে এক পডকাস্টে বলেন, ‘চীনের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, তারা যেন ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ষষ্ঠ স্থায়ী সদস্য হতে সমর্থন দেয়। বর্তমানে জাতিসংঘের এটাই সবচেয়ে বড় ঘাটতি। ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এবং একধরনের পরাশক্তি; বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার বৈধতার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের থাকা প্রয়োজন। ভারতই একমাত্র দেশ, যাদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার সুস্পষ্ট দাবি আছে। ভারতের অন্তর্ভুক্তি বহুপক্ষীয়তা ও বৈশ্বিক শান্তি- উভয়ই সুসংহত করবে। তবে এ অবস্থানে পৌঁছাতে হলে দুই দেশের মধ্যে আস্থার পুনর্গঠন জরুরি বলেও মনে করেন জেফরি স্যাক্স। এক্ষেত্রে প্রধান বাধা সীমান্ত সমস্যা; বিশেষত হিমালয় অঞ্চলের সীমান্তরেখা নিয়ে বিরোধ। এই সীমান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। বৃটিশ কর্মকর্তা ম্যাকমোহন- যিনি কখনো ওই এলাকায় যাননি- মানচিত্রে রেখা এঁকে দেন, যে রেখা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে। স্বাধীনতার পর ভারত সেই ‘ম্যাকমোহন লাইন’কে সীমান্ত হিসেবে মেনে নেয়। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যার শিকড় হলো বৃটেন-ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ, ক্রাইমিয়ার সংকট, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা- সবকিছুর পেছনে আছে ঔপনিবেশিক যুগের বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ।
এ বাস্তবতায় ভারত, চীন ও রাশিয়ার একতা বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এই তিন দেশের বিশাল জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রযুক্তির সমন্বয় শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে তুলবে। মার্কিন ডলারের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে তারা নিজেদের আর্থিক ও বাণিজ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। এর মধ্যদিয়ে তারা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পারবে। সরবরাহব্যবস্থা পুনর্গঠন ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগে বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য বদলে যাবে। সীমান্ত বিরোধ ও আস্থার ঘাটতি আছে ঠিক, তা সত্ত্বেও এই একতা বহুপক্ষীয় বিশ্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।