কলকাতার চিঠি

নোবেল জয়ের লক্ষ্যে মরিয়া ট্রাম্প, নানা অজুহাতে শুল্ক রাজনীতির খেলায় মেতেছেন

পরিতোষ পাল | আন্তর্জাতিক
আগস্ট ৩০, ২০২৫
নোবেল জয়ের লক্ষ্যে মরিয়া ট্রাম্প, নানা অজুহাতে শুল্ক রাজনীতির  খেলায় মেতেছেন

মাত্র কয়েক মাস আগেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ভালো বন্ধু ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ জন্য ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা ছাড়াও সাধারণ মানুষের অনেক কটাক্ষ শুনতে হয়েছে মোদিকে। অথচ সেই বন্ধু মোদির উপর ট্রাম্প হঠাৎ শুল্কের তরবারি উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেন? 
শুল্ক যুদ্ধকে সামনে টেনে আনা হয়েছে। ভারত বেশি শুল্ক আরোপ করার অজুহাতে ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করেছেন ৭ই আগস্ট থেকে। এবার রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র আমদানির শাস্তি হিসেবে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প।  ২৭শে আগস্ট থেকে তা কার্যকর হয়েছে। তবে এই শুল্ক যে আরও বাড়তে পারে তারও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। এসব কি ট্রাম্পের একান্তই খামখেয়ালি, নাকি এটাই ট্রাম্পের বর্তমান শাসন কালের কৌশল? 


ভারতের দীর্ঘ দিনের কৌশলগত অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের আচরণে আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ঝড় উঠেছে। সবাইকে দাপট দেখিয়ে শুল্ক চুক্তির নামে বাণিজ্য চুক্তি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে এখন পর্যন্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পূর্ণ করা যায় নি। রাশিয়া ইস্যু নিয়ে ভারতের মনোভাব স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত চুক্তি নিয়ে আলোচনাও স্থগিত রেখেছেন ট্রাম্প। 
রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য ট্রাম্প ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থায়ন  এবং একইভাবে ইউক্রেনে হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতকে দায়ী করছেন। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্ববাজারকে স্থিতিশীল রাখতে ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনাকে এক সময় উৎসাহিত করেছিল। তবে ভারতের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কড়া অবস্থানের পর মোদি এখন পর্যন্ত মাথা নত করেন নি। এমনকি ভারতের অর্থনীতিকে ট্রাম্পের মৃত আখ্যা দেয়ার পরও মোদি সরাসরি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মুখ না খুললেও দৃঢ় অবস্থানের কথা নানা ভাবে জানিয়েছেন।  রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধের জন্য চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি ট্রাম্প মার্কিন কৃষিপণ্য ও ডেইরিকে ভারতের বাজারে অবাধ প্রবেশের জন্য চাপ দিয়ে এসেছে বাণিজ্য আলোচনায়। ভারত তা মানেনি।  মোদি কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন,  তিনি ভারতের কৃষক, দুগ্ধ মালিক এবং মৎস্যজীবীদের স্বার্থ রক্ষায় কোনো আপস করবেন না। এ জন্য তাকে ব্যক্তিগত শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলেও মোদি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।  
রাশিয়া থেকে আসলে যুক্তরাষ্ট্র ৬০ ডলার প্রতি ব্যারেল তেল কেনার শর্ত দিয়েছিল। কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। ভারত রাশিয়া থেকে সুযোগ বুঝে কম দামে তেল  কিনেছে। এ ব্যাপারে ভারতের যুক্তি হলো, জাতীয় জ্বালানি স্বার্থ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়েছে। 


অথচ মজার বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র যে ধারাবাহিক ভাবে রাশিয়া থেকে পণ্য কিনে চলেছে তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই ট্রাম্পের। বরং যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শিল্পের জন্য রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড, তার ইভি শিল্পের জন্য প্যালাডিয়াম, সার এবং রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি অব্যাহত রাখার বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পের ভণ্ডামি ভারত তুলে ধরেছে। 
তবে ভারত ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের মোকাবিলায় কতোদিন কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকতে পারবেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত   শুল্কের ধাক্কায় বিভিন্ন শিল্পে সংকট তৈরি হওয়ায় আশঙ্কা করেছেন ব্যবসায়ীরা। লাখ লাখ মানুষ কাজ হারাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের শেয়ারবাজারে উথাল-পাথাল চলছে। 
তবে ভারতের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের রুষ্ট হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। ট্রাম্প গত তিন মাসে ৩০ বারের বেশি ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাতে সফল দৌত্যের দাবি করেছেন। এমনকি এর সঙ্গে বাণিজ্যকেও যুক্ত করেছেন ট্রাম্প। কিন্তু ভারত এই দাবি মানেনি। ট্রাম্পের প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও ভারত জানিয়েছে, পাকিস্তানের অনুরোধেই তারা সংঘর্ষ বিরতিতে মত দিয়েছিল। এখানে যে ট্রাম্পের কোনো ভূমিকা ছিল না সেটাই ভারত স্পষ্ট করেছে বারে বারে। ভারতের এই নীতির ফলে ট্রাম্পের নোবেলের স্বপ্ন যে আঘাতের মুখে পড়েছে সেটা নানা ভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারত যে ট্রাম্পের নাম নোবেলের জন্য সুপারিশ করবে না সেটাও স্পষ্ট। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের শান্তি না হলে যে ‘শান্তির ট্রাম্প’ অভিধা থেকে তিনি ছিটকে যাবেন। আর তাই রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির জন্যও ভারতকে টেনে আনা হচ্ছে।


ফলে রাশিয়া, ভারত ও ইউক্রেন- এই জটিল রাজনীতির সঙ্গে ট্রাম্পের নোবেলের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। অনেক দেশি- বিদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে ট্রাম্পের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জনের বাসনা কার্যকর করা। সেই লক্ষ্যেই তিনি সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
আসলে শান্তির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার লোভ ট্রাম্পের বহুদিনের। এক সময় তার গলায় এ জীবনে নোবেল পাওয়া হবে না বলে আফসোসও শোনা গিয়েছে। বেস লেভিন ভ্যানিটি ফেয়ার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ডনাল্ড ট্রাম্প জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে অনুরোধ করেন নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নাম প্রস্তাব করতে। আবে নোবেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে ট্রাম্পকেও নোবেল দিতে অনুরোধও করেছিলেন। ট্রাম্প আবেকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলেন, আমি হয়তো নোবেল পাবো না। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। ওরা ওইটা ওবামারে দিলো। সে তো জানতোই না কীসের জন্য ওই পুরস্কার পেলো। পনেরো সেকেন্ডের জন্য এলো আর পুরস্কার পেয়ে গেল। সেই বছরেই  পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তার একখান নোবেল অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু ওরা এটা ঠিকমতো দেয় না। আবার ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প বলেছিলেন, আমি একটা দেশ বাঁচালাম, আর শুনলাম দেশটাকে বাঁচানোর জন্য কৃতিত্বের পুরস্কার পেলো ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী। তবে এবার যত ব্যক্তি ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার জন্য  ওকালতি করেছেন তা অতীতে কখনো হয়নি।  পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, আজারবাইজান, ইসরাইল আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পকে নোবেল দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছে।


গত ৩১শে জুলাই ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন নেতৃত্বের জন্য ট্রাম্পকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত। এর ছয় ঘণ্টা পর আবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারেলিন লেভিট বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ছয় মাসের শাসনে পৃথিবীতে মাসে একটা করে শান্তিচুক্তি বা যুদ্ধবিরতি সম্পাদন করেছেন। তার আরও আগেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। সোজা কথায়, একটি নয়, দুটি নোবেল পুরস্কার ট্রাম্পের জন্য বরাদ্দ করার দাবি তোলার চেষ্টা হচ্ছে।


মিশর ও ইথিওপিয়া, সার্বিয়া ও কসোভো, ইসরাইল-ইরানের মধ্যে শান্তি স্থাপনের পাশাপাশি সমপ্রতি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া এবং আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব ট্রাম্প নিজেই দাবি করেছেন। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সমঝোতা করতে পারলে ট্রাম্প নিঃসন্দেহে উদ্বাহু তুলে নৃত্য করবেন। সেটা এখন পর্যন্ত সফলভাবে করতে না পেরে বিশ্বের যেখানেই শান্তি সমাধানের খোঁজ চলছে সেখানেই তিনি নাক গলানোর চেষ্টা করে চলেছেন। সমপ্রতি দুই কোরিয়ার মধ্যে শান্তি আলোচনাতেও ট্রাম্প অংশ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উত্তর কোরিয়া সাফ না করে দেয়ায় ট্রাম্প মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছেন। 


এদিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের সুপারিশ যে জরুরি সেটা ট্রাম্প নিজেও জানেন। ট্রাম্পের নিজের কথায়, আমি একটা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবো না ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ বন্ধের জন্য? তবে প্রায় ছয়টি যুদ্ধ বিরতির সাফল্য তার আস্তিনে থাকা সত্ত্বেও নোবেল কমিটি কী করবেন তা আগামী দিনে স্পষ্ট হবে। তবে অনেকের আশঙ্কা, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত নোবেল না পেলে কতো রকমের শাস্তির খড়্‌গ যে কতো দেশের উপর নেমে আসবে তা আগামী দিনেই স্পষ্ট হবে। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর