প র্য বে ক্ষ ণ

ঐকমত্য কমিশন মত-দ্বিমত-ভিন্নমত যেখানে

আরিফুল ইসলাম | নেপথ্যের গল্প
আগস্ট ২, ২০২৫
ঐকমত্য কমিশন  মত-দ্বিমত-ভিন্নমত যেখানে

আলোচনা চলেছে প্রায় পাঁচ মাস। স্থান বদলেছে- সংসদের এলডি হল থেকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে। বদলেছে দিন-তারিখ, কিন্তু উত্তাপ কমেনি আলোচনার টেবিলে। ৬৮টি বৈঠক, ৩০টি রাজনৈতিক দল, ৯৫টিরও বেশি ইস্যু আর সব মিলিয়ে একটিই লক্ষ্য- আগামীর বাংলাদেশ, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক চুক্তির রূপরেখা। এই পরিশ্রমের নামই ‘জুলাই সনদ’। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, তারা ১৯টি মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ঐকমত্যের চেয়েও এখন বড় প্রশ্ন-এই সনদে কে কে স্বাক্ষর করবে? এবং সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি কী দিবে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চালিয়ে আসার পর জামায়াত ও এনসিপি বলছে, জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি না দিলে তাতে তারা সই করবে না। আবার শেষ দিনের বৈঠকে সিপিবি ও বাসদসহ চার বামপন্থি দল জাতীয় চার নীতি বাদ দেয়াকে কেন্দ্র করে বৈঠক বর্জন করে বলেছে, কমিশনে প্রস্তাবে পরিবর্তন না এলে জুলাই সনদে তাদের সই করার সম্ভাবনা নেই। এর আগে দ্বিতীয় দফার বৈঠকে ওয়াক আউট করেছিল বিএনপি, এবং একদিন কমিশনে আসা বর্জন করে জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জাতীয় সনদের এখনই আইনি ভিত্তি প্রয়োজন নেই। জুলাই ঘোষণাকে সংবিধানের চতুর্থ তফশিলে যুক্ত করতে চায় তারা। পুরো ঘোষণাপত্র নয়, অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি হিসেবে একটি অনুচ্ছেদ এবং ঘোষণাপত্রের উল্লেখ থাকবে। 


কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে, সেগুলোর তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোকে জানানো হবে। সেই ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল তৈরি করা হবে এবং সব দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে তাকে চূড়ান্ত রূপ দেয়া হবে। চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে আপনাদের জানাবো এবং আশা করি সবাই তাতে সই করবেন। তিনি আরও বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোই সিদ্ধান্ত দেবেন এই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। এর আগে কমিশনের খসড়া সনদে আগামী নির্বাচিত সংসদ দুই বছরের মধ্যে এই সনদ বাস্তবায়ন করবেন বলে অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়। 


১৯টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট বিশেষত উচ্চকক্ষ গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি ও এখতিয়ার, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেক্টোরাল কলেজ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সমপ্রসারণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।
রাষ্ট্র সংস্কারের ইস্যুগুলোয় রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত ১২ই ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় ৭ সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিগত প্রায় ৫ মাসে সংস্কারের ইস্যুগুলো নিয়ে এ কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। গত ৩রা জুন থেকে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক শেষ হয়েছে।  দুই দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ৯৫টি ইস্যুতে কমিশন আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে ৬৮টি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নিতে মার্চের মাঝামাঝি থেকেই একে একে রাজনৈতিক দলগুলো হাজির হয় রাজধানীর বিভিন্ন ভেন্যুতে। কেউ মতামত জমা দেয়, কেউ সরাসরি মুখোমুখি বসে আলোচনা করে। কারও কারও বক্তব্য ছিল ক্ষীণ, কেউ আবার দিয়েছেন ১০৮টি পর্যন্ত পরামর্শ। এসব নিয়েই গঠিত হয় একটি বড় রাজনৈতিক নথি- জুলাই সনদ।


জানা গেছে, এই আলোচনায় ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, দফায় দফায় হয় বৈঠক। কখনো এনসিপি, কখনো বিএনপি, কখনো বা জামায়াতে ইসলামী। একের পর এক দিন পাল্টেছে, কিন্তু আলোচনার টেবিলে উত্তাপ কমেনি।


কমিশন সূত্র জানায়, দলগুলোর মতামত, দ্বিমত ও ভিন্নমত মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া, যেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও রাখা হয়েছে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে।
প্রথম দফা বৈঠক হয় জাতীয় সংসদের এলডি হলে। ১৭ই মার্চ প্রথম লিখিত প্রস্তাব জমা দেয় আমার বাংলাদেশ পার্টি। ১০৮টি প্রস্তাবে একমত জানায় তারা। ২০শে মার্চ প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয় লেবার ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে। একধাপ এগিয়ে ১২০টি প্রস্তাবে একমত জানায় এলডিপি। এরপর একে একে ২১শে মার্চ খেলাফতে মজলিস ও লেবার পার্টি, ২২শে মার্চ লেবার পার্টি, ২৩শে মার্চ বিএনপি, সিপিবি ও এনসিপি একদিনে তিন দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। ২৪শে মার্চ প্রস্তাব জমা দেয় নেজামে ইসলাম পার্টি, ২৫শে মার্চ আলোচনায় বসে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এপ্রিলের ৭ তারিখ এবি পার্টি ফের বৈঠকে অংশ নেয়। ৮ই এপ্রিল নাগরিক ঐক্য জানায়, তারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিপক্ষে। ৯ই এপ্রিল মতামত দেয় গণঅধিকার পরিষদ ও বিকল্প ধারা, ১০ই এপ্রিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ১২ই এপ্রিল জাসদ, ১৩ই এপ্রিল গণফোরাম ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম মত দেয়। ১৭ই এপ্রিল বাসদ জানায়, সংসদের মেয়াদ ৫ বছর হওয়া উচিত, প্রধানমন্ত্রী থাকবেন সর্বোচ্চ দু’বার। ২১শে এপ্রিল গণফ্রন্ট ও খেলাফতে মজলিস অংশ নেয় আলোচনায়। ২৬শে এপ্রিল জামায়াতে ইসলামীর বৈঠকে উঠে আসে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব- একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়। তারা সংবিধানে বহুত্ববাদের বদলে একাত্মবাদের সুপারিশ করে। ২৭শে এপ্রিল আলোচনায় বসে গণসংহতি আন্দোলন। ১লা মে সিপিবি, ৪ঠা মে ১২ দলীয় জোট, ৬ই মে জাতীয় নাগরিক পার্টি- একে একে বৈঠকে বসে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি- (এনসিপি) বলছে,  মৌলিক সংস্কার মানে শুধু নির্বাচনী নয়, ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা, বিকেন্দ্রীকরণ- এটাই মূল। আর এই সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি না দিলে সনদে স্বাক্ষর করবো না। 


১০ই মে গণফোরাম, ১২ই মে বাম ঐক্য ও নেজামে ইসলাম পার্টি কমিশনের মুখোমুখি হয়। ১৮ই মে জামায়াতে ইসলামী ও ১৯শে মে সিপিবি’র বর্ধিত আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয় প্রথম দফা। প্রথম দফার বৈঠকে বিএনপি জানায়, টানা দুইবারের বেশি না পারলেও বিরতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকা দরকার।
২রা জুন থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় দফা আলোচনা, স্থান এবার ফরেন সার্ভিস একাডেমি। কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানান, এখানে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন দলের সঙ্গে ইস্যু ভিত্তিক আলোচনা হয়।
২০টি মৌলিক ইস্যু, ২৩ দিনের আলোচনা, ৩০টি দলের অংশগ্রহণে গঠিত হয় ঐকমত্য, দ্বিমত ও নোট অব ডিসেন্টসহ পূর্ণাঙ্গ আলোচনা। ৩১শে জুলাই দীর্ঘ আলোচনার সমাপ্তি ঘটে এই দিনে। ঐকমত্য হয় ১৯টি বিষয়ে, বাকিগুলো নিয়ে এখনো দলগুলো দ্বিধায়।


দ্বিতীয় দফার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বিষয়ে ঐকমত্য আসে বিএনপি থেকে। বৈঠকের শুরু থেকেই সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ কমিশন আগে যা এনসিসি নামে গঠন করেছিল কমিশন, এটার বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য জানায় দলটি। তবে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা একক ব্যক্তি হতে পারবে না এ ব্যাপারে একমত নয় দলটি। এদিকে কমিশন জানায়, দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একক ব্যক্তি হতে পারবে না। উচ্চকক্ষ গঠিত হবে নিম্নকক্ষের ভোটের আনুপাতিক হারে (পিআর)। নারী আসন সংসদে ১০০ হবে তবে বর্তমান সংরক্ষিত ৫০টি থাকবে- সঙ্গে দলগুলো ৫-৭ শতাংশ সরাসরি নারী মনোনয়ন দেবেন। 
বিএনপি বলছে, পরবর্তী সংসদে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়ার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবে দ্বিমত নয় তারা। আর দুই বছরের সময়সীমা নিয়েও আমরা একমত। আর কমিশনের ৮২৬টি প্রস্তাবের মধ্যে বেশির ভাগই মেনে নিয়েছি। আর ৫১টিতে দ্বিমত পোষণ করেছি। আশা করি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোতেও একটি সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব।  জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি বলছে, সনদের আইনি ভিত্তি নেই। কিন্তু জামায়াত মনে করে, সনদের বাস্তবায়ন প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করলে হবে না। আইনি ভিত্তি না থাকলে সনদ মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সেজন্য আমরা কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করবো।


মৌলিক সংস্কারে যেখানে আপত্তি: সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জোরালো আপত্তি আছে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের। তারা এ সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে যুক্ত না করে আইনের মাধ্যমে নিয়োগ করার পক্ষে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে অর্থাৎ সারা দেশে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে তারা উচ্চকক্ষে আসন পাবে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল এই প্রস্তাবে একমত। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের এতে আপত্তি আছে। রাষ্ট্রের মূলনীতি প্রশ্নেও দলগুলো মোটাদাগে বিভক্ত। সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ করার প্রস্তাব নিয়েও এখন পর্যন্ত সেভাবে আলোচনা হয়নি। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হলেও নিষ্পত্তি হয়নি।
চার মাসের পথচলায় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ, মতভেদ আর নীতি-কৌশল নিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘জুলাই সনদ’- যার লক্ষ্য রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক চুক্তি। এখন দেখার বিষয়, এই ঐকমত্যের পথে এগিয়ে যাওয়া কতোটা সম্ভব হয়। 

নেপথ্যের গল্প'র অন্যান্য খবর