সা ম্প্র তি ক

পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘বাংলাদেশ দর্শন’

সোহরাব হাসান | মতামত
আগস্ট ৩০, ২০২৫
পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘বাংলাদেশ দর্শন’

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ সফরটি ছিল কূটনৈতিকভাবে ততটা না হলেও রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেছেন।
ইসহাক দারের সফরকালে  বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি ও চারটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে।  চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের একে অপরের দেশ সফর করতে ভিসার প্রয়োজন হবে না।  সমঝোতা স্মারকগুলো (এমওইউ) হলো- দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন। দুই দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা। দুই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার (বাসস ও এপিপিসি) মধ্যে সহযোগিতা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সঙ্গে পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের (আইএসএসআই) সহযোগিতা। এগুলোর নিশ্চয়ই গুরুত্ব আছে। কিন্তু রাজনৈতিক মহলের মনোযোগ কেড়েছে একাত্তর প্রসঙ্গে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য এবং তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ এবং শফিকুর রহমানের হার্টের অপারেশন হয়েছে সমপ্রতি। ইসহাক দার তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইতে পারেন। এটা নিছকই সৌজন্য সাক্ষাৎ না এর পেছনে অন্য কোনো তাৎপর্য আছে, সেটা হয়তো এখনই জানা যাবে না।


১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম সফর। এর আগে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি ঢাকা সফর করেছিলেন। এরপর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি দেয়াকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তান সে সময় এর নিন্দা জানায় এবং দেশটির পার্লামেন্টেও সমালোচনা করা হয়। একাত্তরের বিষয়টি দু’বার মীমাংসা হয়েছে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক মহলে তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রতিবাদ হয়েছে। ইসহাক দারের দাবি, ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। এরপর ২০০০ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এখানে (বাংলাদেশে) এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে অনুশোচনা প্রকাশ করে বিষয়টির সমাধান করেছেন। পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ডন সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ঢাকা অখণ্ড পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী সহিংস অস্থিতিশীলতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণের দাবির ওপর জোর দিচ্ছে। অন্যদিকে ইসলামাবাদ মনে করে, এই প্রশ্নগুলোর ইতিমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে পাকিস্তানের প্রতি তার বৈরী মনোভাব এবং ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ককে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তারপর থেকেই বাংলাদেশে পরিবর্তন আসতে থাকে।


সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার পরামর্শটি ভালো উদ্দেশ্যতাড়িত হলেও ভারতের একগুঁয়েমির কারণে এই মুহূর্তে এটি অবাস্তব, এমনকি যদি এটি চেষ্টাযোগ্যও হয়। ইতিমধ্যে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে জারি রয়েছে একটি ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া। এই ফোরাম তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরালো করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। আর অগ্রগতির জন্য একসঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক অন্যান্য আঞ্চলিক দেশকে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে।


ভারতের টেলিগ্রাফের সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল: শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। উভয় দেশ নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। সেই সুবাদে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান এ সম্পর্ক নিয়ে দ্য টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয়তে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ‘ওয়াচ ক্লোজলি: এডিটরিয়াল অন দ্য শিফট ইন বাইল্যাটারেল রিলেশন্স বিটুইন পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে নয়াদিল্লিকে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির পরামর্শও দেয়া হয়।
সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, ভারতের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ইসহাক দারের বৈঠক। তিনি জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও সেই ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যারা শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। বাংলাদেশে ২০২৬ সালের শুরুর দিকেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগে পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে, যা নিঃসন্দেহে নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগের কারণ। সম্পাদকীয়তে ভারতকে ঢাকার সঙ্গে কাজ করার পথ বের করারও পরামর্শ দেয়া হয়।


বাংলাদেশের কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ইসহাক দারের মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন। দ্বিমত পোষণ করেছেন স্বয়ং পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও। তারা বলেন, এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো সরকার একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চায়নি। ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতে আটক সব পাকিস্তানি বন্দিকে ছেড়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো একাত্তরের বিপর্যয়ের জন্য সেনা নেতৃত্বকে দায়ী করে ‘তওবা’ করার কথাও বলেছিলেন। গণহত্যায় সেনাবাহিনীর দায় নিরূপণে তিনি হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করলেও বোধগম্য কারণে সেটি প্রকাশ করেননি। নব্বইয়ের দশকে কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে জানা যায়, কেবল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয়, ভুট্টোসহ পাকিস্তানি নেতারাও গণহত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছেন। কূটনৈতিক মহল জানিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যে তিনটি বিষয়ে এখনো অমীমাংসিত আছে তা হলো, একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়া ও একাত্তর-পূর্ব সম্পদের হিস্যা আদায়। মাস ছয়েক আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের সফরের সময়ও বাংলাদেশ একাত্তরের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরে।


পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সফরের কথা উল্লেখ করে ইসহাক দার বলেন, ‘তিনি (পারভেজ মোশাররফ) প্রকৃতপক্ষে নমনীয়ভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আমি মনে করি, পরিবারের মধ্যে বা ভাইদের মধ্যে ঘটলে এসব করা হয়। এমনকি ইসলাম আমাদের বলেছে, “তোমাদের দিল পরিষ্কার করো।”
পাকিস্তানকে মনে রাখতে হবে, এটি ‘পরিবার’ বা ‘ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার বিষয় ছিল না, এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে দিল পরিষ্কার করার কথা বলেছেন, সেটাও ধোঁয়াশাপূর্ণ। এর মাধ্যমে তিনি গণহত্যাকারী ও এর শিকারদের এক কাতারে নিয়ে এসেছেন। যারা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে তাদের দিল পরিষ্কার করার প্রয়োজন আছে। কিন্তু যারা একাত্তরে সর্বস্ব হারিয়েছেন, তাদের দিল পরিষ্কার করার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের মানুষের দিল পরিষ্কার বলেই পাকিস্তানি সেনা ও শাসকদের বর্বরতা ক্ষমা করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন শীর্ষ কর্মকর্তাকেও ছেড়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন একমত কিনা, সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমি একমত নই। আমি যদি একমত হতাম, তাহলে তো সমস্যার সমাধানই হতো। বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার। আমরা একাত্তরের দেনা-পাওনার হিসাব চাই। একই সঙ্গে একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করি। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নিতে হবে।’


তৌহিদ হোসেন স্বীকার করেন যে, ‘একাত্তরের বিষয়টি একদিনে সমাধান হবে না এবং আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়েছি।’
২০১৩ সালের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। গত বছর গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা গতি আসে। সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে গেলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ইসহাক দারের সফরকে দুই দেশের মধ্যে ‘একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক’ বলে অভিহিত করলেও একাত্তরের ইস্যুটি আনুষ্ঠানিকভাবে মীমাংসা না করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন আদৌ সম্ভব কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। 

মতামত'র অন্যান্য খবর