কলকাতার চিঠি

তালেবান মন্ত্রীর ভারত সফর আলোচনায় যে কারণে

পরিতোষ পাল | মতামত
অক্টোবর ১১, ২০২৫
তালেবান মন্ত্রীর ভারত সফর  আলোচনায় যে কারণে

দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এক সপ্তাহের জন্য ভারত সফরে এসেছেন। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এটিই তার প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের ভারত সফর। অবশ্য গত ৩০শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তালেবান নিষেধাজ্ঞা কমিটি মুত্তাকির ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে তুলে নেয়ার মাধ্যমে  বিশেষ ছাড় দেয়ার পর এই সফর সম্ভব হয়েছে। মুত্তাকি ২০০১ সাল থেকে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার অধীনে রয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ জব্দ এবং অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। তবে ভারত সফরে ভারতীয় কর্মকর্তারা সফররত তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পূর্ণ কূটনৈতিক প্রটোকল দিচ্ছেন।
 

এই সফরে মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে নানা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। আলোচনায় মুত্তাকি জয়শঙ্করকে বলেন, আমরা পারস্পারিক শ্রদ্ধা, বাণিজ্য এবং জনগণের সাথে মানুষের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক চাই। আমরা আমাদের সম্পর্ক জোরদার করার জন্য একটি পরামর্শমূলক ব্যবস্থা তৈরি করতে প্রস্তুত। এই বৈঠকে ভারতও কাবুলে ভারতীয় দূতাবাস খোলায় সম্মতি দিয়েছে। মুত্তাকির সফরসূচিতে দেওবন্দের দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং তাজমহল পরিদর্শনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়াও, তিনি ব্যবসায়িক মহল এবং ভারতে অবস্থিত আফগান সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করবেন।
আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সবসময়ই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও সভ্যতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানরা যখন ক্ষমতা দখল করে এবং আফগানিস্তানের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল তখন ভারত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ভারত আফগানিস্তানে থাকা তার কনস্যুলেট এবং দূতাবাস বন্ধ করতে খুব বেশি সময় নেয়নি। ভিসা বাতিল করে এবং দেশ থেকে ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতেও তারা দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। 
 

তবে তালেবান সরকারের  প্রতিষ্ঠার  কয়েক সপ্তাহ পরে কাতারে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধানের সঙ্গে দেখা করে ভারতের নিরাপত্তা এবং স্বার্থ রক্ষার আশ্বাস চেয়েছিলেন। কিন্তু তালেবান সরকারকে স্বীকৃতির প্রশ্নে ভারত গররাজি ছিল। তাই আজও ভারতে আফগান দূতাবাস ও কনস্যুলেটে সাবেক গনি সরকারের আমলের পতাকাই লাগানো রয়েছে। তালেবান সরকারের নিযুক্ত দূতকেও ভারত মান্যতা দেয়নি। আসলে তালেবান সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ভারত দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আবার আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও ভারতকে ভাবাচ্ছিল। তালেবানদের প্রত্যাবর্তনের পরপরই আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে এই গোষ্ঠীর নীরব সমর্থন এবং সহায়তা এবং ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রভিন্স এবং বিশেষ করে ভারতের স্বার্থের প্রতি বিরূপ গোষ্ঠী, যেমন আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট, লস্কর-ই-তৈয়েবা এবং জইশ-ই-মোহাম্মদের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ নয়াদিল্লির আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছিল। তাই প্রথম দিকে ধীরে চলার নীতি নিয়ে চললেও পরবর্তী সময়ে ভারত নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা শুরু করে। 
২০২২ সালের জুনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম সচিবের কাবুল সফরের পর নয়াদিল্লি সাহায্য সরবরাহের সুবিধার্থে এবং পর্যবেক্ষণের জন্য সেদেশে একটি প্রযুক্তিগত মিশন পরিচালনা করে। এই অস্থায়ী, অনিচ্ছুক সম্পৃক্ততা এখন বাস্তবতার নিরিখে তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্কের অনিবার্যতা নীরবে গ্রহণযোগ্যতায় রূপান্তরিত হয়েছে।
 

এই বছরের শুরুতে, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব দুবাইতে মুত্তাকির সঙ্গে দেখা করেন। সেটি  ছিল উভয় পক্ষের মধ্যে প্রথম উচ্চ স্তরের আলোচনা। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তা থেকে শুরু করে বাণিজ্য ও সাহায্য সরবরাহের উদ্দেশ্যে চাবাহার বন্দরের গুরুত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তালেবানের অধীনে থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বিবৃতিতে ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক খেলোয়াড়’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। এপ্রিলে পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলও মুত্তাকির সঙ্গে দেখা করে। এরপর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মুত্তাকির মধ্যে টেলিফোনে কথোপকথন হয়, যেখানে ভারত পেহেলগামে হামলার নিন্দা জানানোর জন্য তালেবানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তালেবানরা শুধু হামলার নিন্দা জানিয়েছিল তাই নয়,  আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার উপর এর বিরূপ প্রভাবের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। ফলস্বরূপ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ভারতকে তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আরও সুযোগ করে দিয়েছে।
 

তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনকে তুলে ধরা হবে। অন্যদিকে তালেবান মন্ত্রী নয়াদিল্লির প্রতি ভিসা প্রদান পুনরায় শুরু করা, সাহায্য বৃদ্ধি করা এবং উন্নয়ন সহায়তার ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য অনুরোধ জানাবে। ভারতকে তার অবকাঠামো প্রকল্পগুলো পুনরায় শুরু করা এবং দুই দেশের মধ্যে বিনিয়োগকে স্বাগত জানানোর জন্যও এই সফর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। বর্তমান বৈঠকে নয়াদিল্লিতে তালেবান-সমর্থিত রাষ্ট্রদূত নিয়োগের বিষয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বহুদিন ধরেই রাষ্ট্রদূত শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে নয়াদিল্লির আফগান দূতাবাস। 
 

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততা তৈরির চেষ্টার অন্যতম কারণ হলো ভারতের আঞ্চলিক  নিরাপত্তা ঝুঁকিকে কমিয়ে আনা। তালেবানের সঙ্গে আঞ্চলিক দেশগুলোর যোগাযোগ বৃদ্ধিও ভারতকে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পদক্ষেপ করার কৌশল নেয়ায় প্রণোদিত করেছে। এ বছরের জুলাইয়ে, রাশিয়া প্রথম দেশ, যারা ইসলামিক আমিরাতকে আইনত স্বীকৃতি দিয়েছে। চীন, ইরান এবং মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রের মতো অন্যান্য দেশগুলো যদিও আইনত স্বীকৃতি দেয়নি; তবে তারা সকলেই তাদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করেছে, হয় রাষ্ট্রদূত বিনিময়ের মাধ্যমে অথবা তাদের দূতাবাসের নিয়ন্ত্রণ তালেবান নিযুক্ত প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে।
 

অন্যদিকে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে তালেবান সরকার পররাষ্ট্রনীতি-সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তববাদী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। যার মূল লক্ষ্য হলো ‘ভারসাম্যপূর্ণ এবং অর্থনৈতিক পররাষ্ট্রনীতি’। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তারা আর তাদের অস্তিত্বের জন্য ইসলামাবাদের উপর নির্ভরশীল নয়। পাকিস্তানের উপর তাদের অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে আলাদা একটি পরিচয় তৈরি করছে।
সার্বিকভাবে তালেবান সরকারের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, কৌশলগত এবং নিরাপত্তা বিবেচনায় তালেবানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির অনিবার্যতাকে মেনে নিলেও  শেষ পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্ক কোন পথে মোড় নেবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। তেমনি আগামীদিনে ভারত বাস্তবে তার স্বার্থ সুরক্ষিত করতে পারবে কিনা তা নিয়েও উদ্বেগ থেকে যাবে। 

মতামত'র অন্যান্য খবর