সাম্প্রতিক

তারেক রহমানের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত

ড. মাহফুজ পারভেজ | এক্সক্লুসিভ
ডিসেম্বর ২৪, ২০২৫
তারেক রহমানের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত

বিএনপি তথা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ধারায় তারেক রহমানের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত। একদা তাকে নিয়ে ‘তারেক রহমান: অপেক্ষায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রামাণ্য গ্রন্থও রচিত হয়েছিল। তাতে ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে’ নামের একটি প্রবন্ধে তারেক রহমানের রাজনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়ে আমি আলোকপাত করি। তখনকার পরিস্থিতি ছিল এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ। ১/১১-পরবর্তীতে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামো ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছিল। তখন অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রত্যাশা সমাজের গভীরে সুপ্ত থাকলেও তা সফল হয় নি। 
 

১৯ বছর প্রবাসে থেকে তরুণ তারেক রহমান বাংলাদেশ নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তা করেছেন। রাষ্ট্র সংস্কারের কথা ভেবেছেন। দলের হাল ধরেছেন। অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে তরুণ তারেক রহমান পরিণত হয়েছেন প্রাজ্ঞ ও ঋদ্ধ রাজনীতিবিদে। একটি দায়িত্বশীল অস্তিত্বে তিনি বাংলাদেশে আসছেন প্রকৃতই বীরের বেশে। 
 

তারেক রহমান যখন দেশে ফিরছেন, তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক  ইতিহাস তার নিজস্ব উত্থান-পতনের গতিতে এক নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উপনীত হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের অভিঘাতে দীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক-ফ্যাসিবাদী অধ্যায়ের যবনিকা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের সূচনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি Critical Juncture বা নির্ধারক মোড় সৃষ্টি করেছে। এটি এমনই এক মুহূর্ত, যখন কাঠামোগত সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক রূপান্তরকে যৌথযাত্রাকে নেতৃত্বের কৌশলগত অবদানের ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে হয়। এবং এরই নিরিখে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ চরিত্র নির্মিত হয়। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের এমনই এক রাজনৈতিক যুগ-সন্ধিক্ষণে। 
 

অতএব, দীর্ঘ ১৯ বছরের প্রবাস জীবন শেষে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে কেবল একটি ব্যক্তিগত বা দলীয় ঘটনা হিসেবে পর্যবেক্ষণ করলে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ ও অতিসরলীকৃত হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক পরিভাষায়, এটি একটি ‘Leadership Re-entry Moment’। এ ধরনের মুহূর্তে, নির্বাসন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও দীর্ঘকালীন অনুপস্থিতি একজন রাজনৈতিক নেতাকে নতুন প্রজ্ঞা, কৌশলগত ধৈর্য ও সংগঠনিক গভীরতা দান করে। এখানে তারুণ্যের আবেগী উদ্দীপনা প্রতিস্থাপিত হয় পরিণত অভিজ্ঞতা ও ভারসাম্যবোধ দ্বারা; ক্ষণিকের প্রতিক্রিয়ার স্থান দখল করে নেয় দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের দূরদৃষ্টি। এমন প্রত্যাবর্তন নতুন রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়। বিশ্বের নানা দেশের নির্বাসন-ফেরত নেতৃত্ব বিজয়ীর বেশে ফিরে এসে রাষ্ট্রগঠন ও জাতিগঠনের এমনই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
 

তারেক রহমানকে সেই গুরুদায়িত্বই পালন করতে হবে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নবায়ন এবং নানা মত ও পথে বিভাজিত যুদ্ধংদেহী রাজনীতিকে সমন্বিত করার মাধ্যমে। যে মধ্যপন্থি সর্বসমন্বয়ের ধারা সূচনা করেছিলেন তার পিতা, বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এবং পরবর্তীতে যে ধারার নেতৃত্ব সফলভাবে দিয়েছেন তার মা, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তারেক রহমান সেই রাজনীতির ধারবাহিকতা ও উত্তরাধিকারের শীর্ষ-প্রতিনিধিত্বকারী।  
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, তার সূত্রপাত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে। তিনি ডান ও বাম-এই দুই চরম মেরুকে সংযোজন করার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ নামক একটি Integrative Ideology এর সূচনা করেছিলেন। এই মতাদর্শিক কাঠামোর লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ ও গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতাকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ছাতার নিচে একত্রিত করা। এটি কোনো উগ্র বা একমাত্রিক মতাদর্শিক প্রকল্প ছিল না। বরং এটি ছিল ঔপনিবেশিক-উত্তর একটি নবীন রাষ্ট্রের সমাজে বিদ্যমান বাস্তব বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রয়াস।
পরবর্তী পর্যায়ে, বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ় নেতৃত্বে এই মধ্যপন্থি জাতীয়তাবাদী ধারা বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও পরবর্তীকালের ফ্যাসিবাদী শাসনামলের বিরুদ্ধে সংগ্রামী প্রতিরোধের শক্তিশালী বাহনে রূপ নেয়। তার অধীনে বিএনপি কেবল একটি প্রচলিত ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল হিসেবে নয়, বরং ‘Authoritarian Rollback’ বা কর্তৃত্ববাদী পশ্চাদপসরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি প্রাতিষ্ঠানিক মঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই পর্যায়ে দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে মধ্যপন্থার একটি স্থিতিশীল ধারা অব্যাহত রাখে-না ডানপন্থি চরমপন্থাকে আঁকড়ে ধরে, না বামপন্থি বিপ্লববাদী রোমান্টিকতায় আত্মনিমজ্জিত হয়ে।
 

এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার তৃতীয় অধ্যায় বা বর্তমান স্তরে তারেক রহমানের রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকাকে পর্যালোচনা করতে হবে। তার বক্তব্য, রচনা ও কৌশলগত ইঙ্গিতসমূহ গভীরভাবে পরীক্ষা করলে একটি স্পষ্ট ‘Liberal-Pluralist Centrism’ এর আবহ পাওয়া যায়। তিনি ধর্মকে বাংলাদেশি সমাজের একটি গভীর ও জীবন্ত বাস্তবতা হিসেবে শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু ‘ধর্মীয় রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নেন নি। একইভাবে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে রাষ্ট্রের নৈতিক-ঐতিহাসিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন, কিন্তু সেই চেতনাকে সংকীর্ণ, উগ্র জাতীয়তাবাদী বা একমাত্রিক ইতিহাসচর্চার হাতিয়ারে পরিণত করতে অস্বীকৃতি জানান। তার এই স্বচ্ছ ও উদার অবস্থানকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘Non-Dogmatic, Inclusive Nationalism’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়-এমন একটি জাতীয়তাবাদ যা বহুত্ববাদকে আলিঙ্গন করে, গণতান্ত্রিক চর্চাকে অগ্রাধিকার দেয় এবং সমঝোতাভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে সকল ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল, লিঙ্গ ও গোষ্ঠীর সামাজিক ঐক্য কামনা করে।
 

মনে রাখা দরকার যে, ফ্যাসিবাদ-উত্তর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণ কোনো স্বয়ংক্রিয় বা সুপ্রতিষ্ঠিত প্রক্রিয়া নয়। জুয়ান লিন্‌জ ও আলফ্রেড স্টেপানের মতো রূপান্তর তাত্ত্বিকদের মতে, এ ধরনের ক্রান্তিকালে প্রায়ই একটি ‘Vanguard Leadership’ এর প্রয়োজন হয়-এমন নেতৃত্ব যা সমাজকে প্রতিশোধ ও পাল্টা-দমনচক্রের দিকে না টেনে, বরং জাতীয় পুনর্মিলন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও রাজনৈতিক সহনশীলতার পথে নির্দেশনা দিতে সক্ষম। এই তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে, তারেক রহমানের সামনে চ্যালেঞ্জ দ্বিমুখী ও সুবিশাল। একদিকে, তাকে একটি গভীরভাবে বিভক্ত সমাজে ‘ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ঐকমত্য’ (Democratic Minimum Consensus) প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা ভিন্নমত, নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। অন্যদিকে, তাকে দলীয় রাজনীতিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, কালো টাকা, পেশিশক্তি ও অনিয়ম থেকে মুক্ত করে শক্তিশালী, জবাবদিহিমূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার আধারে পরিণত করার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে।
 

সংগ্রাম, ত্যাগ ও নির্বাসনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে তার প্রত্যাবর্তন যদিও এক প্রকার ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে দেখা দিয়েছে, তবুও তার সামনের পথ মসৃণ নয়। ফ্যাসিবাদ-উত্তর রাজনৈতিক পরিবেশে ‘গণতন্ত্রের পুনর্গঠন’ বলতে কেবল নিয়মিত নির্বাচন আয়োজন করাকে বোঝায় না। বরং এর অর্থ বিচারব্যবস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা, প্রশাসনিক জবাবদিহি, মিডিয়ার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা, বিরোধী মতের সংগঠিত হওয়ার নিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি, রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সম্পর্কের পুনঃসংজ্ঞায়ন। এই দুরূহ অভিযাত্রায় তারেক রহমান যদি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সেই মধ্যপন্থি, বহুত্ববাদী ও উদারনৈতিক ধারাকে শক্তিশালী করে তার ‘ভ্যানগার্ড’ বা অগ্রনায়কে পরিণত হতে পারেন, তবে ইতিহাস তাকে কেবল একজন রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবেই নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এক ‘Transition Leader’ বা রূপান্তর পর্বের নেতা হিসেবেই স্মরণ করবে। তার সাফল্য বা ব্যর্থতা কেবল একটি দলের ভাগ্য নির্ধারণ করবে না, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের তাত্ত্বিক ও বাস্তব কাঠামোকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। 
বাংলাদেশ যখন ফ্যাসিবাদী অন্ধকার-অতীত থেকে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আলোকময় প্রহরের দিকে শত সংকুলতা পেরিয়ে ধাবমান, তখন সুযোগ্য নেতৃত্বের দায়-দায়িত্ব অপরিসীম। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন এবং নেতৃত্বের আলোকপ্রভা বাংলাদেশের অন্ধকার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে সম্ভাবনার আশাবাদী ঝিলিক। 
 

লেখক: চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর