কলকাতার চিঠি

অনুপ্রবেশের জুজু ও হাসিনাকে আশ্রয়

পরিতোষ পাল, কলকাতা | মতামত
নভেম্বর ১৬, ২০২৪
অনুপ্রবেশের জুজু ও হাসিনাকে আশ্রয়

ভারতে নির্বাচনের দামামা বাজা মাত্র প্রচারে বাংলাদেশ ইস্যু হয়ে উঠেছে। একদিকে শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি অনুপ্রবেশের জুজু নিয়ে যে বেশ আতঙ্কিত সেটাই স্পষ্ট হয়েছে নির্বাচনী প্রচারে। অবশ্য এজন্য প্রবল কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়েছে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রধান ও ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের কাছ থেকে। সোজাসুজি দ্বিচারিতার অভিযোগ এনে সোরেন বলেছেন, অনুপ্রবেশ নিয়ে যখন বিজেপি সরকার এত কথা বলছেন তাহলে হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেয়া হলো কেন? কেন বাংলাদেশ নিয়ে ভারত সরকার ও ভারতীয় জনতা পার্টি নেতারা দ্বৈত ভূমিকা নিচ্ছেন? ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও একযোগে নিশানা করেছেন তিনি।
ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতা সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছেন,  আপনি  (মোদি) কি বাংলাদেশের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যবস্থা করেছেন? আপনি কেন হাসিনাকে বহনকারী বিমানকে ভারতে নামতে দিলেন?


বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে ভারত সরকার ও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারা নানা অভিযোগ প্রচারে নিয়ে আসছেন। কয়েকদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গে এসে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী নিয়ে গুরুতর অভিযোগ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে। একই অভিযোগ করেছেন অমিত শাহ ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে। কয়েকদিন আগেই অনুপ্রবেশের ফলে ঝাড়খণ্ড দ্বিতীয় বাংলাদেশে পরিণত হতে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন ঝাড়খণ্ডের ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা জগদম্বা পাল। একই সুরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা আদিবাসী জনজাতিদের জমি দখল করে নিচ্ছে। অভিযোগ করা হয়েছে, আদিবাসী নারীদের ফুঁসলিয়ে বিয়ে করে এই জমি হাতানোর কাজ চলছে। 


পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডকে একই ব্র্যাকেটে রেখে অমিত শাহ বলেছেন, এই দুই রাজ্য সরকারই ভোট ব্যাংকের দিকে লক্ষ্য রেখে অনুপ্রবেশকে মদত দিচ্ছে। অথচ এরা নাকি চেষ্টা করলেই অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পারে। 
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এবার অনুপ্রবেশকেই প্রধান ইস্যু করেছেন নির্বাচনী প্রচারে। মোদি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছেন, তুষ্টিকরণের রাজনীতি চরমে নিয়ে গিয়েছে বিরোধীরা। সরাসরি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা পার্টিকে তিন শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে মোদি বলেছেন, এই তিনটি রাজনৈতিক দল অনুপ্রবেশকারীদের সমর্থন করছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভোট পাওয়ার জন্যই এদের বসবাসের জায়গা করে দিচ্ছে বিরোধী দলগুলো। কিন্তু বিরোধী নেতাদের মতে, সীমান্ত পাহারা দেয়ার কাজ তো ভারত সরকারের। তাহলে অনুপ্রবেশের দায় রাজ্যগুলোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে কেন? বরং অনুপ্রবেশের দায় নিতে হবে ভারত সরকারকেই। 
অনুপ্রবেশের সঙ্গে ভোট ব্যাংকের রাজনীতিকে জুড়ে দিয়ে বিজেপি সরকার বদলের ডাক দিয়েছেন। এমনকি বিজেপি নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বিজেপি ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সব অনুপ্রবেশকারীদের তাড়িয়ে দেবে। আদিবাসীদের সব জমি উদ্ধার করবে।


রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, অনুপ্রবেশ ইস্যু নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি মেরূকরণের রাজনীতির খেলা খেলছে। এটা নতুন নয়। উগ্র সামপ্রদায়িকতার নীতি নিয়েই ভারতীয় জনতা পার্টি দেশ শাসন করছে বলে অনেকেরই অভিমত। আর তাই পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর রাজনীতির সঙ্গে অনুপ্রবেশকে সহজেই জুড়ে দিয়ে হিন্দু ও অন্যান্য জনজাতিদের আবেগকে উস্কে দেয়ার কাজ চলে। 
ভারতে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে এ মাসেই। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে উপ- নির্বাচন হবে। আর এই নির্বাচনী প্রচারে ভারতের শাসক দল অনুপ্রবেশের জুজু দেখানো শুরু করেছে। কংগ্রেস নেতা ও সাবেক মন্ত্রী জয়রাম রমেশ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ভারতীয় জনতা পার্টি সামপ্রদায়িকতার ভাইরাস ছড়াচ্ছে। ধর্মের নামে ভারতীয় জনতা পার্টির শীর্ষ নেতারা ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টায় মেতেছে।  


ভারতে যে অনুপ্রবেশ নিয়মিত হয়ে থাকে সেটা অস্বীকার করার বিষয় নয়। ভারতে অনুপ্রবেশ হয় নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও বংলাদেশ থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সীমান্ত খুবই সামান্য। সেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুবিশাল সীমান্ত। প্রায় ৪০২৪ কিলোমিটার। এই সীমান্তের অনেকাংশে কাঁটা তারের বেড়া দেয়া হলেও অরক্ষিত ও নদীপথে সীমান্ত খুব একটা কম নয়। আর তাই সীমান্তের দু’পাাশের সংগঠিত দালাল চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশিরা  ভারতে আসেন। তারা নানা কারণে ভারতে আসেন। চিকিৎসা, পর্যটনের মতো বিষয় ছাড়াও শ্রমিক ও  গৃহ কাজের আশায় ভারতে আসেন। আর তাই ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই বাংলাদেশিদের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে। আর এটাও সত্য, এই সব বাংলাদেশির বড় অংশই বছর বছর বাংলাদেশে ফিরেও যায়। অনুপ্রবেশ নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার এক প্রতিনিধির মতে, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সুবিধার জন্যই অনুপ্রবেশ সহজেই ঘটে থাকে। সেই সঙ্গে নির্যাতন ও স্বজনদের টানেও অনেকে ভারতে চলে আসেন স্থায়ীভাবে। তিনি বলেন, অনুপ্রবেশের সমস্যা শুধু এই অঞ্চলেই নয়। গোটা বিশ্বেই এই সমস্যা রয়েছে। তবে ভারতে ভারতীয় জনতা পার্টি হিন্দুবাদী রাজনীতির স্বার্থে অনুপ্রবেশকে অন্যতম সমস্যা হিসেবে তুলে ধরছে। 


পশ্চিমবঙ্গে আগামী ’২৬ সালের নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে অনুপ্রবেশ ইস্যুকেই বড় করে তোলা হবে- তা স্পষ্ট হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামপ্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরে দেয়া ভাষণে। সীমান্ত এলাকায় জনবিন্যাসের পরিবর্তনেরও অভিযোগ তোলা হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।  অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় যাবার জন্য মরিয়া হয়ে অনুপ্রবেশকে হাতিয়ার করেছে। বিশেষ করে আদিবাসী অধ্যুষিত সাঁওতাল পরগনায় ভারতীয় জনতা পার্টি গতবার মাত্র কয়েকটি আসন পেয়েছিল। এবার সেখানে থাবা বসাতে চাইছে বলেই আদিবাসীদের আবেগে প্রবলভাবে নাড়া দিতে সক্রিয় হয়েছে।  তবে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সব সংগঠন নিয়ে গঠিত ঝাড়খণ্ড জন অধিকার মহাসভা প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ভারতীয় জনতা পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ভাষণ দেয়ার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো মামলা করার জন্য রাজ্যের পুলিশের মহানির্দেশক ও মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে। এদিকে জাতীয় তফসিলি আদিবাসী কমিশনের রিপোর্টে সাঁওতাল পরগনায় জনবিন্যাস দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে বলা হলেও সমীক্ষার সময় তারা আদিবাসীদের জমি দখলের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারেন নি। বরং অনুপ্রবেশ ইস্যুকে তুলে ধরার জন্যই আদিবাসী এলাকায়  সরকারি প্রকল্পের অভাব, স্থানীয় স্তরে জমি নিয়ে বিরোধ থেকে শুরু করে মানব পাচারের মতো সমস্যাকে সরকারের কাছে পেশ করা রিপোর্টে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় নি বলে অভিযোগ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার।   


অন্যদিকে অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে ভারতের ভারতীয় জনতা পার্টি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে চরম হেনস্তা করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ ব্যাপারে বারে বারে অভিযোগ করেছে। অবৈধ বাংলাদেশি হিসেবে ধরপাকড়ের নামে বিভিন্ন রাজ্যে বস্তিতে  বা ঝুপড়িতে থাকা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি পরিযায়ীদের ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশি হিসেবে অভিযুক্তও করা হচ্ছে। 

মতামত'র অন্যান্য খবর