সা ম্প্র তি ক

আমরা শাসক না, জনবান্ধব পুলিশ চাই

গাজী আসাদুজ্জামান | মতামত
নভেম্বর ১৬, ২০২৪
আমরা শাসক  না, জনবান্ধব পুলিশ চাই

অনেকদিন আগে ভারতীয় চ্যানেলে ক্রাইম পেট্রোল সতর্ক একটি এপিসোড দেখেছিলাম। সেখানে এক পুলিশ অফিসার এবং তার স্ত্রী ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কাজের মেয়ের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাতেন। এমন কী বাসনকোসন ঠিকমতো ধোয়া হয়নি কেন? এটা এখানে কেন? ওই কাজটি হয়নি কেন-এই বলে খুন্তির ছ্যাঁকা এবং গরম পানি শরীরে ঢেলে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটাতেন। এমন কী সামান্য ছোটখাটো ভুল নিয়ে খাবার দেয়াও বন্ধ করে দিতেন। এক পর্যায়ে কাজের মেয়েটি তাদের অমানবিক অত্যাচার ও নিপীড়নে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মুমূর্ষু অবস্থায় সে ওই পুলিশ অফিসার এবং তার স্ত্রীর অগোচরে বাসা থেকে বেরিয়ে একটি রেলস্টেশনে আশ্রয় নেয়। স্টেশনে এসে সে জ্বরে প্রলাপ বকছিল। পরবর্তীতে ওই রেলস্টেশনে অন্য এক পুলিশ অফিসারের নজরে আসে কাজের মেয়েটি। ওই পুলিশ অফিসার মেয়েটির মুমূর্ষু অবস্থা দেখে নিজ খরচে মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এবং মেয়েটিকে সুস্থ করে তুলেন। পরবর্তীতে তাকে বাসায় এনে কিছুদিন রেখে ওর বাবা-মায়ের কাছে মেয়েটিকে পৌঁছে দেন। সমাজে সব পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীই যে খারাপ তা নয়। পুলিশের মধ্যেও ভালো পুলিশ আছে। ভালো পুলিশ না থাকলে এই ডিপার্টমেন্ট চলতো না। মুখ থুবড়ে পড়তো। 


বিগত সময় পুলিশ বিভাগের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে হাত করে হাসিনা সরকার পুলিশ বিভাগকে নিজের কব্জায় নিয়ে নেন। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ঢাকা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যেক জেলা-উপজেলার প্রত্যেকটি থানাকে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড় থেকে শুরু করে দমন-পীড়নে ব্যবহার করেন। এতেই তিনি ক্ষান্ত থাকেন নি, পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুকুম দেন রাজাকারের বাচ্চাদের  (কোটাবিরোধী ছাত্রদের) গুলি করে ফেলে দাও।       
পুলিশ হচ্ছে জনগণের সেবক। জনগণের জান-মাল রক্ষা, এর সঙ্গে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি প্রতিরোধ করা সর্বোপরি সমাজের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই পুলিশের কাজ। সড়কে যানজট নিরসন, ট্রাফিকিং বিষয়টিও তাদেরই এখতিয়ারে পড়ে। দেশের সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ সেই সঙ্গে নির্বাচনকালীন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পুলিশের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। 


চ.ঙ.খ.ও.ঈ.ঊ প্রত্যেকটি ইংরেজি অক্ষরের অর্থ দ্বারায় চ.(চড়ষরঃব) [মার্জিত], ঙ. (ঙনবফরবহঃ) [বাধ্য] খ. (খড়ুধষ) [বিশ্বস্ত], ও. (ওহঃবষষরমবহঃ) [বুদ্ধিমান], ঈ. (ঈড়ঁৎধমবড়ঁং) [বীরত্বপূর্ণ], ঊ. (ঊভভরপরবহঃ) [দক্ষতা]। এই অক্ষরগুলো নিয়েই পুলিশ গঠিত। বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে এই গুণগুলো নেই বললেই চলে। যে কারণে আমাদের পুলিশ বাহিনী নিয়ে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে। হাসিনা সরকারের সময় পুলিশ বাহিনীকে সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবেই গড়ে তোলা হয়। পুলিশের বড় বড় কর্তাদের হাত করে সাবেক সরকার পুলিশ বাহিনীকে বিরোধী দল দমনে ব্যবহার  করেছে। এমনকি নির্বাচনের সময় পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে দিনের ভোট রাতে দিয়ে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসেছে। শুধু তাই-ই নয়, পুলিশ বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা সাবেক সরকারের সময় বুক ফুলিয়ে সভা-সমিতিতে বলতেন- ‘এই সরকারকে আমরাই ক্ষমতায় বসিয়েছি।’ আমরাই ক্ষমতায় রাখছি। 


হাসিনা সরকারের শেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে দু’দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। ঢাকা ফিরে আসার আগের দিন রাতে আমার এক আত্মীয় বানিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিল্টু আনসারীর বাড়িতে গেলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। উঠোনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকলাম ‘চেয়ারম্যান বাড়ি আছো কিনা?’ বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পরও কোনো সাড়া-শব্দ পেলাম না। ফিরে আসার আগে দরজায় টর্চের আলো ফেলতেই দেখলাম মস্ত বড় এক তালা। তালা দেখে ভাবলাম ওরা হয়তো বেড়াতে গেছে। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসবো ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে খুট শব্দ করে কাজের মেয়েটি বেরিয়ে এসে বললো ‘আপনি কাকে চান? থানা থেকে এসেছেন বুঝি’? আমি বললাম না। আমি বিল্টু চেয়ারম্যানের ভগ্নিপতি। ঢাকা থেকে এসেছি গত পরশু। ভাবলাম ঢাকা যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। ঘরে তালা দেখে ফিরে যাচ্ছিলাম। ‘আমাদের কথোপকথনের শব্দ শুনে আমার শ্যালক বদ্ধঘর থেকে বুয়াকে বললো, ‘বুয়া তালা খুলে দাও’। উনি পুলিশ না। উনি আমার ভগ্নিপতি। বুয়া তালা খোলার পর আমার শ্যালক বললো, ‘পুলিশের তাড়া খেয়ে খেয়ে এই বুদ্ধি ধরেছি’। বুয়াকে বললো, ‘বুয়া তুমি সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকো। পুলিশের গাড়ি দেখলেই আমাকে সংকেত দিবে’। এরপর আমার শ্যালক আমাকে নিয়ে ঘরে বসালো। বললো, ‘কয়েকদিন আগে একটি ঘটনা ঘটে গেছে। রাত বারোটার দিকে পুলিশ গাড়ি নিয়ে আমাকে ধরতে এসেছিল। আমি বিএনপি করি বলে ওরা আমাকে ধরতে এসেছিল। আমি টের পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাই। ওরাও আমার পেছনে পেছনে ছুটে আসে। পরবর্তীতে আমি ছুটতে ছুটতে একটি গোরস্থানে গিয়ে লুকাই। ওরা আমাকে না পেয়ে চলে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখি কয়েকটা শিয়াল আমাকে ঘিরে ধরলো। ভয়ে ভয়ে আমি বললাম- ‘শিয়াল ভাইরা, আমি তো খুব বিপদে পড়ে এখানে এসেছি। একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে তোরা। আমাকে খাবি না’। একথা বলার পর ওরা নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করলো। তারপর কি যেন মনে করে সবাই চলে গেল। এরপর আমি গোরস্থান থেকে চলে এলাম। সেই থেকে পরিবারের সবাইকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে রাতের বেলা তালা লাগিয়ে বদ্ধঘরে আবদ্ধ থাকি। এ কারণেই ঘরে তালা মেরেছি। একটি সময় ছিল যখন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতেন। নদী, বিল, হাওর, ক্ষেতের জমিতে রাত কাটাতেন।      


আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। রাত ৮টার দিকে বাসে করে বাসায় ফিরছিলাম। মধ্যবাড্ডা পৌঁছাতেই ট্রাফিক সার্জেন্ট আমাদের বাসের ড্রাইভারকে ইশারা করলেন বাস থামাতে। বাসের ড্রাইভার বাস থামাতেই ড্রাইভারকে বললেন, ‘তোর গাড়ির কাগজপত্র দে’। ড্রাইভার গাড়ির কাগজপত্র পুলিশ সার্জেন্টের হাতে দিয়ে বললেন, ‘স্যার... কাগজপত্র সব ঠিক আছে, দেখুন। কোনো ধারায়ই আমাকে আটকাতে পারবেন না’। পুলিশ সার্জেন্ট ড্রাইভারকে ইশারা করে বললেন, ‘ওই আকাশের দিকে তাকা। দেখছোস কতো তারা। ঠিক পুলিশেরও ততো ধারা। কোন ধারায় তোকে ফেলবো সেটা তো আমার বিষয়। ড্রাইভার আর পুলিশ কর্মকর্তার এই বাদানুবাদের সময় গাড়ির কন্ডাক্টর নেমে গেলেন এবং পুলিশ সার্জেন্টের হাতে পাঁচশ’ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘স্যার ওর কথায় কিছু মনে নিবেন না’- এই বলে সার্জেন্টের হাত থেকে কাগজপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে এলেন। আমাদের গাড়িটি আবার চলতে শুরু করলো। হাসিনা সরকারের সময় রাস্তাগুলোতে এই দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়তো। এটা তখন একটা প্রচলিত বিধান হয়ে গিয়েছিল।


যে পুলিশের মধ্যে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নেই, মানবিকতা নেই, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, মানুষের প্রতি দরদ নেই, এরকম পুলিশ আমরা চাই না। আমরা বেনজীর, আছাদুজ্জামান মিঞা আর ক্রাইম পেট্রোলের সেই এপিসোডের প্রথম পুলিশ কর্মকর্তার মতো পুলিশ চাই না। আমরা পুলিশ চাই ক্রাইম পেট্রোলের সেই দ্বিতীয় পুলিশ কর্মকর্তার মতো। যার মধ্যে রয়েছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ, মানবিকতা আর দায়িত্ববোধ। আমরা ক্রাইম পেট্রোলের দ্বিতীয় পুলিশ কর্মকর্তার মতো পুলিশ চাই। আগামীতে যারা পুলিশ বিভাগে কাজ করবেন তাদেরকে এই দায়িত্ববোধ থেকেই কাজ করতে হবে। জনগণের বন্ধু হিসেবে, জনগণের খাদেম হিসেবে। আমরা আর স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সেইসব দুষ্ট প্রকৃতির অর্থ লুটপাটকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী, ঘুষ-বাণিজ্যকারী,  সরকারের লেজুড়ধারী পুলিশ চাই না, যারা সরকারের তল্পিবাহক হয়ে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় আর পেট্রোল ঢেলে লাশ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আমরা চাই আগামীর চ.ঙ.খ.ও.ঈ.ঊ. হোক জনতার পুলিশ। মানবিকতার পুলিশ। জনগণের পুলিশ। 

মতামত'র অন্যান্য খবর