সুপ্রিয় হাসু আপা,
তিন মাস। মানে ৯০ দিন আপনাকে টিভির পর্দায় দেখি না। বুকটা ফাইট্টা যায়। তখন মমতাজের গানটা খুব মনে পড়ে। আমার বন্ধু যখন বউ লইয়া/ আমার চোখের সামনে দিয়া/রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়/ফাইট্টা যায়- বুকটা ফাইট্টা যায়.../আপনার বুকটাও যে ফাইট্টা যাচ্ছে সেটা না বললেও আমরা আন্দাজ করতে পারি। ইদানীং আপনার কথাবার্তায়ও ফাইট্টা যাওয়ার আভাস পাওয়া যায়। এই তো সেদিন নূর হোসেন দিবসকে কেন্দ্র করে আপনি আপনার দলের এক কর্মীকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন কীভাবে দিনটি পালন করবে। মার্কিন নির্বাচনে জয়ী ডনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে সবাইকে নূর হোসেন চত্বরে যেতে বললেন। একই সঙ্গে বললেন, সেখানে হামলা হবে। সেই ছবি তুলে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিতে। আপনার সঙ্গে ট্রাম্পের ভালো সম্পর্ক আছে সেটাও বললেন। সেই ছবি ট্রাম্পের কাছে পাঠিয়ে আপনি জানান দেবেন ইউনূস সরকার ট্রাম্প বিরোধী। তাই তো ট্রাম্পের ছবি নিয়ে মিছিলে পুলিশ দিয়ে অ্যাকশনে গিয়েছে। আরও অনেক কু-বুদ্ধি দিয়েছেন। যা সেই সব দেশবাসী শুনেছেন। এসব শুনে দেশের মানুষ আপনার আসল চেহারা চিনতে পারছে। ওই নেতাকে আপনি এও বললেন, ওরা এত মানুষকে মেরেছে। পুলিশকে মেরেছে। হাস্যকর কথা আপা। এত জলজ্যান্ত সত্য কথা কীভাবে বলতে পারেন আপনি। একটুও কি বিবেকে বাধে না? শত শত ছাত্র-জনতাকে আপনার নির্দেশে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি করে মেরেছে। আপনার ছাত্রলীগ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা চালিয়েছে। আপনি তখন রাজ সিংহাসনে বসে মিটিমিটি হেসেছেন নিশ্চয়? আর এ বিষয়টি এখন বলছেন, ওরা মেরেছে। আপনি পারেনও বটে। আপনি আরও হাজার বছর বেঁচে থাকুন। মানুষ আপনার কাছ থেকে এমন কূটচাল শিখতে পারবে। কি বলবো বলুন? বিএনপিও বোকা। এরা না পারে আন্দোলন করতে, না পারে আপনার শাসন আমলের ব্যর্থতাগুলো দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে। এরা শুধু ক্ষমতায় যেতে চায়। আর তাইতো আপনি গত প্রায় ষোলটি বছর ষোল হাজার বার বলেছেন, এদেশে আর বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হবে না। সংবিধানও সেভাবেই সাজিয়েছিলেন। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে এভাবে আপনার স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দেবে কে ভেবেছিল? দেশের মানুষ এটাকে নিয়তি ধরে বসেছিলেন। আর উপরওয়ালার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছেন। উপরওয়ালা যে এভাবে আপনাকে মসনদ ছাড়া করবে এটা তো মানুষ জানে না। এখন আপনার চোখের সামনে দিয়ে ক্ষমতায় যাবে বিএনপি-জামায়াত। আপনি দেশের সীমানার বাইরে বসে এ দৃশ্য টিভি পর্দায় দেখবেন। কেমন লাগবে আপনার? খুব জানতে ইচ্ছে করে। দেশটাকে বারটা বাজিয়ে এখন অন্য দেশের আশ্রিত হয়ে বসে আছেন। শুধু বসে আছেন বললে ভুল হবে। কূটচাল করছেন। ষড়যন্ত্র করছেন। আপনার দলের নেতাকর্মীদের কু-পরামর্শ দিচ্ছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করার সকল চেষ্টা চালাচ্ছেন। এটা দেখেই বুঝা যায়-এ দেশের প্রতি আপনার কতোটুকু মায়া। আসলে দেশের প্রতি নয়, সিংহাসনের প্রতি আপনার মায়া আপনাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। তাই তো আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি বড়ই বেঈমান। ওরা আপনার সাজানো বাগানে জল ঢেলে দিয়েছে। আচ্ছা আপনি যখন গণভবন ছেড়ে যান তখন নিশ্চয় চোখের কোনায় পানি জমেছিল। কিন্তু কিচ্ছু করার ছিল না।
হাসু আপা, মনে পড়ে ২০০১ সালে আপনার প্রথম সরকারের মেয়াদ যখন শেষ হয় তখন গণভবন ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল। দেশবাসী তা টিভি পর্দায় দেখেছে। সেদিন মিডিয়ার সামনে আপনার যে ব্যবহার দেখেছে দেশবাসী সবাই খুবই কষ্ট পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে আপনি যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন ওই ভবন আপনার। কিন্তু আপনি যেতে চাইলেন না। অবশেষে গেলেন মনে কষ্ট নিয়ে। তাইতো ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেন। আর এরপরই গণভবন আপনার জন্য বরাদ্দ নিয়ে নিলেন। আর যেন গণভবন না ছাড়তে হয়। শুধু তাই নয়, আপনার পুত্র, কন্যা, বোন, বোন ঝি, বোনের ছেলে সবার জন্য আলাদা আলাদা বাড়ি বরাদ্দ দিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, আজীবন এসএসএফ সুবিধা পাবে এমন বিধিও যুক্ত করলেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে দেয়া সরকারের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বিধি লঙ্ঘন করে বের করে দিলেন। আপনার মনে এত প্রতিহিংসা! এটা ভাবা যায় না। আপনি রাজনীতিতে খেলতে ভালোবাসেন-এটা গত ষোল বছরে প্রমাণ হয়ে গেছে। এত বেশি খেলেছেন যে প্রকৃতি তা সহ্য করতে পারেনি। ধপাস করে পড়ে গেছেন। যুগে যুগে দেশে দেশে এমন স্বৈরাচারের জন্ম হয়। দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করে। দেশের আমজনতার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন অবলীলায় চালিয়ে যায়। এভাবে একদিন নিজেকে উপরওয়ালার চেয়ে শক্তিধর মনে করে। আপনিও তাই মনে করেছিলেন। তাই তো আপনি প্রায়ই বলতেন ষোল কোটি জনগণকে খাওয়াতে পারছি আর দশ লাখ রোহিঙ্গাকে খাওয়াতে পারবো না। আবার নিজেই বলেছেন- আমার বাবা বেহেস্তে বসে আজকের বাংলাদেশ দেখছে। এসব নাফরমানি কথা মানুষ তখনই বলে যখন সে নিজেকে গড ভাবে। আপনিও নিজেকে এমনটা ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।
আপা, আপাগো কিন্তু আপনাকে ছাড়া আমরা তো এতিম। আপনি চলে যাওয়ার পর ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখন বাংলাদেশে কেউ আর সাহস করে বলতে পারে না আমি আওয়ামী লীগ করি। সারা বাংলাদেশ খুঁজে কোথাও আপনার কিংবা আপনার পিতার ছবি টানানো দেখা যায় না। কেন গো আপা? এমনটা কেন হলো? একবার নীরবে নিভৃতে ভেবেছেন কী? ভাবুন, ভাবুন। দূর প্রবাসে দেশকে অস্থিতিশীল করার ভাবনা ছেড়ে দিয়ে দলকে ফের চাঙ্গা কীভাবে করবেন সে পরিকল্পনা করুন। কু-বুদ্ধি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন। ষোল বছর ক্ষমতায় থেকে তিন মাসও সহ্য হয় না। এখনই ফের আগের মতো কূটচাল শুরু করেছেন। এসব বাদ দিন। অন্ততপক্ষে ষোলটি মাস যাক। তারপর দল নিয়ে ভাবতে শুরু করুন। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন। যদিও দেশের মানুষ আর আওয়ামী লীগকে গ্রহণ করবে কিনা সেটি নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে। কারণ বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর যতবারই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে ততবারই দেশের অমঙ্গল ছাড়া মঙ্গল হয়নি। কী করেছেন দেশের জন্য? একটু ভাবুন তো। বলবেন উন্নয়ন করেছেন। বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছেন বড় অঙ্কের টাকা দুর্নীতি করার জন্য। সেটা করেছেনও । নিজ দলের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী সবাইকে লেলিয়ে দিয়েছেন লুটপাট করার জন্য। ব্যাংক ফোকলা করে দিয়ে গেছেন।
আপাগো, নূর হোসেন দিবসকে কেন্দ্র করে যে কু-পরামর্শ দিলেন আপনার নেতাকে- একবারও কি চিন্তা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য যে কসরত করেছেন তা দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। সেই ছবি যদি এখন কেউ ট্রাম্পের কাছে পাঠিয়ে বলে দেখুন হাসিনা আর বাইডেনের মধ্যে কতো মধুর সম্পর্ক ছিল। এই ছবিই বলে দেয় দু’জনে কতো হাস্যোজ্জ্বল। মাঝখানে আবার আপনার মেয়ে পুতুলও আছে। কি ভাব আপনাদের মাঝে। এ ছবি দেখে ট্রাম্প কী ভাববেন? কিইবা বলবেন। আর আপনি যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার কিছুই তো দেশে হয়নি। অর্থাৎ আপনার দলের কেউ সেখানে যেতেই সাহস পায়নি। নূর হোসেন চত্বর তথা জিরো পয়েন্ট ছিল ছাত্র-জনতার দখলে।
সবশেষ বলবো- আর কূটচাল না চেলে সোজা পথে হাঁটুন। একদিন দেশের মানুষের ভালোবাসা পেলেও পেতে পারেন। নতুবা এই যে দেশ ছেড়েছেন আর এদেশে আসতে পারবেন কিনা আল্লাহ মালুম। আপনার দল আওয়ামী লীগ অদূর ভবিষ্যতে কতোটুকু যেতে পারবে সে প্রশ্ন তো থেকেই গেল। তাই বলছি- চেহারা পাল্টান, মন বদলান। দেখবেন মানুষের ভালোবাসা পাবেন। তবে এ জন্য আপনাকে কতো যুগ অপেক্ষা করতে হয়- সেটাই দেখার বিষয়।
আপা, আজ এ পর্যন্তই লিখলাম। আগামীতে আপনার আমলনামা এক এক করে আপনাকে মনে করিয়ে দেবো। যদি পারেন শুধরে নিবেন নিজেকে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। এ আশা সবসময় করি।