ওরে চিকন কালা/ তুই যে গলার মালা/ আমি যে তোর আছি চির দাসি/ প্রাণ বন্ধুরে বাজাইওনা এত বিষের বাঁশি...। সত্যিই বিষের বাঁশিই ছারখার করে দিলো সবকিছু। কিন্তু সেই বিষের বাঁশি যে আজও বন্ধ হয়নি। কদম ডালে বসে যখন সেই বাঁশির সুর টান দেয় তখন উজ্জীবিত হয়ে উঠে প্রেমিকের মন। জেগে উঠে ভালোবাসার টান। তাই তো ইতালি, কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপে বসে ভালোবাসার মানুষগুলো জবাব দেয় আপা আপনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে অস্থির করে দেবো। আপনাকে ছাড়া বাংলাদেশ ভালো নেই। এরাই আপনাকে গিলে খেয়েছে। গলার মালা বানিয়ে একেবারে পায়ের তলায় পিষে দিয়েছে। এরা যে যাই বলুক- তাদের কথা না শোনাই ভালো।
প্রিয় হাসু আপা, আপনি কি বুঝেন তাদের ভালোবাসার ধরন। প্রবাসে থেকে আপনার প্রতি প্রেম তাদের উগলে উঠছে। আর দেশে যারা আছে তারা তো এখন আওয়ামী লীগ পরিচয় দিতেই লজ্জা পায়। এ লজ্জার কারণও আপনি। তারা আড়ালে আবডালে বলে আপা এভাবে লজ্জায় ডুবিয়ে গেল আমাদের। এখন মুখ দেখাতে পারি না। যাই হোক আপা, আজ এসব লিখতে বসিনি। আজ আপনার বহু দোষের একটি তুলে ধরতে চাই সবিস্তারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আপা আপনি শিবির নিধনে নামেন। আপনার সকল বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শিবির নিধনযজ্ঞে। সে সময় সারা দেশ যে বিভীষিকাময় করে তুলেছিল আপনার পুলিশ বাহিনী, বিভিন্ন সংস্থা, ছাত্রলীগ তা আজও মানুষের মনে দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়েছে। কোনো যুবক দেখলেই পুলিশ ধরে নিতো সে শিবির। তাকে আটক করে নিয়ে যেতো থানায়। তারপর কারাগারে। এভাবে দেশের লাখো লাখো যুবক আপনার সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের গায়ে শিবিরের তকমা লাগিয়েছেন আপনি। যার শরীরে আপনি নিজে শিবিরের তকমা লাগিয়েছেন সে কি কোনোদিন শিবির থেকে ফিরে আসবে। ওই সব যুবকরা লাইন ধরে শিবির করেছে। এখানে ছাত্রলীগকে সমর্থন করে এমন বহু যুবক রয়েছে। যারা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে ছাই চাপা দিয়ে শিবিরের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এরাই আজ মূলত দেশের শক্তি। এদের মধ্যে এমন ছাত্র-যুবকও আছে যাদের পরিবার জন্ম থেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক। বোমা মারলেও এরা আওয়ামী লীগের বাইরে যেতো না। কিন্তু আপনার ছাত্রলীগ ও পুলিশ বাহিনীর আকামের যন্ত্রণা এরা সহ্য করতে পারেনি। আপনার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ আপনি রাজ সিংহাসনে বসে হেসেছেন সুখের হাসি। কারণ প্রতিপক্ষ শিবিরকে বিনাশ করতে পেরেছেন। এ বিনাশ যে আপনার জন্য সর্বনাশ হয়ে দেখা দেবে- সেটা কোনোদিনও ভাবেননি। প্রতিটি পাতানো নির্বাচনের আগে দেশের প্রতিটি গ্রামের অলিগলিতে পর্যন্ত আপনার পুলিশ বাহিনী বিএনপি-জামায়াত গ্রেপ্তারে উন্মাদ হয়ে উঠতো। আর বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা ধানক্ষেত, জমির আইল, নদীর পাড়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। তারপরও হাজারে হাজারে বিএনপি-জামায়াত ও শিবির, ছাত্রদলের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। সারা দেশে আপনার জেলখানাগুলো পূর্ণ হয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ আসামিতে ঠাসা করে রেখেছিলেন।
প্রিয় হাসু আপা, আপনার এ কেমন আচরণ? সে সময় এসব বিষয় নিয়ে মানুষ কথা বলতেও ভয় পেতো। কারণ তাকেও আপনি কিংবা আপনার বাহিনী জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে দিতো। আপনার এমন হিংসাত্মক কার্যক্রমে আপনি খুশি হলেও দেশের আমজনতা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতো। আপনাকে ঘৃণা করতো। আপনার পরিচয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে। বঙ্গবন্ধু এ দেশের স্বাধীনতার স্থপতি। কিন্তু আপনি? কোথায়, কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? এটা স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও জানতে পারিনি। আপনি প্রায়ই বলতেন বেগম খালেদা জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। কিন্তু সে সময় আপনি কোথায় ছিলেন? একবারও কী মনে পড়েনি?
সে যাকগে অন্যদিকে আজ কথা ঘুরিয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না। বলছিলাম শিবির নিধনের কথা। আপনার প্রায় ষোল বছরের কু-শাসন আমলের বহু কুকর্ম আজ মানুষের মুখে মুখে। আমি নিজেও বহু ঘটনার সাক্ষী। সে সময়ও আকারে ইঙ্গিতে লিখেছি। কিন্তু সেই লেখা দেখে আপনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে আমাকেও নানাভাবে হেনস্তা করেছেন। আপনার কার্যালয় থেকে বহুদিন ফোন পেয়েছি। সে কথা আরেকদিন জানাবো আপনাকে। তবে শিবির নামে সাধারণ মানুষের ওপর যে মর্মান্তিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তার কিছু বর্ণনা এখন দিতে চাই। দুই হাজার তের সালের ঘটনা। ওরা তিনজন সরকারি বিজ্ঞান কলেজের ছাত্র। ফার্মগেট থেকে বাসে উঠে রায়েরবাগ গিয়ে নেমেছে। বাস থেকে নামার পরই কদমতলী থানা পুলিশ তিনজনকে ধরে ফেলে। শিবির ট্যাগ লাগিয়ে থানায় নিয়ে যায়। ওরা যে কলেজ থেকে এসেছে সেটা বলার পরও কোনো কাজ হয়নি। পরদিন ওদের কোর্টে তোলা হয়। কোর্ট থেকে কারাগারে। এই তিন ছাত্রের দুইজনই ছিল আপনি বলতে অজ্ঞান। আপনাকে নিয়ে কতোজনের সঙ্গে যে কথা-কাটাকাটি করেছে ইয়াত্তা নেই। অন্যজন কোনো রাজনীতিই করতো না। শিবির ট্যাগ নিয়ে ওরা জেলে যাওয়ার পর জামায়াত ও শিবির ওদের সব খরচ বহন করতে লাগলো। ওদের পরিবারের খোঁজখবর রাখতো নিয়মিত। উকিলের ফিও দিতো ওরা। যত রকমের সহযোগিতা আছে সবই করেছে জামায়াত-শিবির। কয়েক মাস জেল খেটে বের হওয়ার পর এই দুই ছাত্র আপনার মুখ পর্যন্ত দেখেনি কখনো। এখনো আপনার ছবি দেখলে ঘৃণায় ওরা রি রি করে। এভাবে কতো হাজার, কতো লাখ ছাত্র-যুবককে আপনি নিজ হাতে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন? হিসাব আছে আপনার কাছে। আরেকটি ঘটনা বলি- এমনই এক কলেজছাত্রকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। কোনো দোষ নেই। দোষ সে শিবির করে। এক থানা পুলিশ ধরে দ্রুত তাকে যাত্রাবাড়ী থানায় পাঠিয়ে দেয়। সন্ধ্যা তখন সাতটা। এ পরিবারটিও এলাকায় আওয়ামী পরিবার হিসেবে চিহ্নিত। সারারাত থানায় কাটানোর পর সকাল দশটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসে। ওই থানায় কিন্তু এই ছাত্র একা ছিল না। শিবির ট্যাগ দিয়ে আনা কমপক্ষে শতাধিক ছাত্র-যুবক ছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একজন একজন করে আনা হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেট তাদের কাউকে তিন মাস, কাউকে এক মাস এমন বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিলো। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আপনি যে নতুনভাবে ব্যবহার করেছেন এটা এদেশে প্রথম। ভ্রাম্যমাণ আদালত মানে সরাসরি অনিয়ম ধরবে। সবার সামনে জেল-জরিমানা করবে। আগের দিন আটক করে পরের দিন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়ার নজিরও আপনি সৃষ্টি করেছেন। আপনি পারেনও বটে। ষোল বছরে কতো নতুন কিছু দেখিয়েছেন আপনি- মানুষ তা দেখে অবাক হয়েছে। যেমন ভোটার শূন্য নির্বাচন করে, আগের রাতে ব্যালট ভরে নির্বাচন করে আপনি জোর গলায় বলেছেন জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে জনগণ ভালোবাসে।
আপা, আপাগো, এই জামায়াত-শিবিরকে রাজাকার রাজাকার বলে সব সময় বলতেন। ষোল বছরে লাখো কোটি বার ওদের রাজাকার বলেছেন। অথচ এখন যারা জামায়াত বা শিবির করে কয়েকজন ছাড়া বাকি সবার জন্ম দেশ স্বাধীনের পরে। আর রাজাকার তকমা তো আপনি নিজ হাতে শেষ করে দিয়েছেন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদদের ফাঁসি দিয়ে। এখনকার জামায়াত তো আপনার কথা অনুযায়ী রাজাকার মুক্ত, স্বাধীনতাবিরোধী মুক্ত। আপনি তো নিজ হাতে ওদের মাথা থেকে কলঙ্কের বোঝা নামিয়ে দিয়েছেন। আর সেই কলঙ্ক আপনি নিজ মাথায় নিয়েছেন একে একে আকাম-কুকাম করে। সর্বশেষ কোটাবিরোধী আন্দোলনেও এই মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকার প্রসঙ্গ এনে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেন। যার রেশ গিয়ে পড়ে আপনার গণভবনে। সেখান থেকে পালিয়ে নিজের প্রাণটা বাঁচান। ছিঃ আপা, ছিঃ। লজ্জা হয় আপনার মতো একজন মানুষকে এদেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে।
প্রিয় হাসু আপা, এতটুকু বলি- এই রাজাকার কার্ড এখন আর এ দেশের মানুষ খায় না। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এসে স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ বিষয়টি মানুষ ভালোভাবে নেয় না। আপনি এখন নতুন কার্ডে খেলুন। ভিনদেশে বসে দেশকে অস্থিতিশীল করার পরামর্শ না দিয়ে সত্যিকারের রাজনৈতিক দলের মতো নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিন আর পুরনো খেলা নয়, এখন থেকে নতুন খেলা খেলো। মানুষের কাছে যাও। তাদের মন জয় করো। তাহলেই একদিন যদি আওয়ামী লীগ উঠে দাঁড়াতে পারে। অন্যথায় এ দেশে আওয়ামী লীগ উঠে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে। তবে আপনি একটি কাজ করে গেছেন। স্বৈরাচার এরশাদের দল জাতীয় পার্টিকেও আপনার সঙ্গে রাখতে পেরেছেন। এরাও এখন রাজনীতির বাইরে। এখানেও আপনি নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচার হিসেবে সফল। কারণ জাপা প্রধান সংবাদ সম্মেলন করে আপনাকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন আপনি কীভাবে কোন কৌশলে তাদের সঙ্গে খেলেছেন। আসলে আপনি সত্যিকারেরই একজন খেলোয়াড়। যে খেলায় সাময়িক আনন্দ আছে কিন্তু বেদনা রয়েছে অনন্তকাল।
আজ এ পর্যন্তই আপা। ফাঁস হওয়া আপনার টেলিফোনের কথাবার্তা শুনে মনে হয় আপনি ভালোই আছেন। এমন ভালো সব সময়ই থাকুন। খোদা হাফেজ।