হ ত ভা গা র চি ঠি ৭

এত বুদ্ধি মাথায় আসে কীভাবে?

শামীমুল হক | মতামত
নভেম্বর ৩০, ২০২৪
এত বুদ্ধি মাথায় আসে কীভাবে?

আধ্যাত্মিক গান। এ গানের ভেতরে গেলে পৃথিবী গোলমাল হয়ে যায়। আত্মার খোরাক হয়। পাগল দেওয়ানা হয়ে যান অনেকে। যেমন প্রেমিক তার প্রেমিকার উদ্দেশ্যে গান গাইছে- হৃদয়ের লেনাদেনা/এ পাড়েতে আর হবে না/দেখা হবে, দেখা হবে ওই পাড়ে/তোমার আমার দেখা হবে ওই পাড়ে...। এখানে প্রেমিক বুঝতে পেরেছে এই জগতে আর দেখা হবে না। তারপরও আশা ছাড়েনি। ওই পাড়েতে দেখা হবে সে আশা নিয়ে দিন পার করছে। 


প্রিয় হাসু আপা, ওই প্রেমিকের মতোই আপনার অনেক ভক্ত আপনাকে দেখার আশা ছেড়ে দিয়েছে। তারা ইহজগৎ নিয়ে আর ভাবছে না। পরজগৎ নিয়ে ভাবছে। কিন্তু এ মুহূর্তে আপনার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ শুনে অনেকেই বলছেন, এতবড় ধাক্কা খেয়ে আপনি শোধরালেন না। এখনো আপনার ভালোবাসার কর্মীদের উস্কে দিচ্ছেন দেশের বিরুদ্ধে। এতে কি প্রমাণ হয়? ক্ষমতায় থাকতেও যেমন এ দেশকে আপনি নিজের করে নিতে পারেননি। ক্ষমতা থেকে পালিয়েও এ দেশটাকে রেহাই দিচ্ছেন না। কেন গো আপা? কি এমন কারণ? শুধুই আপনার পরিবারের লোকজনকে হত্যা করাই- এত রাগ, হিংসা আপনার মনে? যদি এটা হয়, তাহলে এ হত্যার বিচার তো আপনি করেছেন। আর রাগ থাকলে হত্যাকারীদের ওপর থাকার কথা। বাংলাদেশের ওপর কেন? সাধারণ মানুষের ওপর কেন? আপনার একটা বক্তব্য এখনো কানে বাজে। ঢাকায় বসে কুমিল্লায় কথা বলছিলেন ভিডিও কনফারেন্সে। এক পর্যায়ে কুমিল্লা সদরের এমপি আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে কুমিল্লা বিভাগ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। বলেন কুমিল্লা নামে কোনো বিভাগ হবে না। কারণ কুমিল্লার মোশ্‌তাক ১৫ই আগস্ট ঘটিয়েছে। এ ছাড়া কু-নাম যেখানে সেখানে তিনি ওই নামে বিভাগ দেবেন না। বিভাগ হলে হবে মেঘনা নামে। বাহ! সরকার প্রধানের কী প্রতিহিংসা। ওই দিনের আপনার বক্তব্য শুনে বৃহত্তর কুমিল্লার মানুষ ছিঃ ছিঃ করেছে। একজন মোশ্‌তাকের কারণে গোটা বৃহত্তর কুমিল্লাবাসীকে আপনি অপমান করেছেন। সাধারণত কু মানে খারাপ। তাদের খারাপ গালি দিয়ে দিলেন। সেদিন আপনার মাঝে মানুষ বস্তির কাইজ্জাখোর মহিলার আচরণ দেখেছে। সেদিনই বা কেন? আপনার এমন আচরণ অহরহ মানুষ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। আজকের দিনে এসে যেন মানুষ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। আপনার আরেকটি নাটকের কথা খুব মনে পড়ে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি’র হরতাল চলছিল। এরই মধ্যে আপনি ঘোষণা দিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করবেন। অবশ্য ফোন করলেন। আপনার চ্যালা-চামুণ্ডাদের পাশে রেখে ফোন করলেন। খালেদা জিয়াকে চা খাওয়ার দাওয়াত দিলেন গণভবনে। খালেদা জিয়া দাওয়াত রেখেছিলেন। তবে বলেছিলেন কাল যেহেতু হরতাল আছে কাল ছাড়া অন্যদিন সময় দিন। আমি আসবো। আপনি তার কথা রাখলেন না। বরং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেদিন আপনি আবারো শপথ ভঙ্গ করেছিলেন। সেদিনের টেলিফোনের ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিলেন। মনে করেছিলেন এতে আপনার লাভ হয়েছে। সেদিন আপনার চ্যালা-চামুণ্ডারা খুশি হলেও খুশি হতে পারেনি দেশের মানুষ। যাদের কারণে আপনি রাজা হয়েছেন। তারা ভয়ে ভয়ে, কানে কানে একে অপরকে বলছিল প্রধানমন্ত্রী কাজটি ঠিক করেননি। একদিন পরে সময় দিতে পারতেন আপনি। আসলে আপনার কৌশল ছিল কোনোরকমে একটি ফোন করা। জাতিকে দেখানো প্রধানমন্ত্রী হয়েও আমি ফোন করেছি। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া আসেননি। তার প্রমাণ হলো- আপনার ফোনের পর থেকেই আপনার দলের শীর্ষ নেতারা এ কথাই জোরেশোরে বলতে থাকে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বলেছিলেন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনটা করছি। এরপর বললেন সবার সঙ্গে বসে সমঝোতা করে ক’দিনের মধ্যেই ফের নির্বাচন হবে। এই ক’দিন চলে গেল প্রায় এগার বছর। আপনার এত ক্ষমতার লোভ। মানুষ তা বুঝে গিয়েছিল। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের কন্যা তার বইয়ে আপনার পিতার ক্ষমতার লোভের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, আপনার পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে বিমানবন্দর থেকে নেমে উঠলেন গাড়িতে। সেই গাড়িতে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। আপনার পিতা গাড়িতে উঠেই বলেছিলেন তাজউদ্দীনরে আমার তো প্রধানমন্ত্রী হতে মন চায়। সেই পিতার কন্যা হয়ে আপনি এর বাইরে যাবেন কীভাবে? 


ও আপা, আপাগো ষোল বছরে আপনার আকামের কতো ফিরিস্তি যে রয়েছে, তা যদি আগামী ষোল বছর লেখা হয় তাও শেষ হবে না। রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে যে গণহত্যা চালিয়েছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সারা দেশ থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা, মাদ্রাসার ছাত্ররা তাদের দাবি নিয়ে ঢাকার মতিঝিলে এসেছিলেন। আপনি সরকার প্রধান হয়ে তাদের নেতাদের গণভবনে ডেকে নিয়ে যেসব দাবি মানা যায় সেসব মেনে নেয়ার আশ্বাস দিতেন। তাহলেই ওরা খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে যেতো। কিন্তু আপনি তা না করে সেদিন আপনার ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে পল্টনের দোকানপাট, ফুটপাথের বইয়ের দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনায় তাণ্ডব চালিয়েছেন। রাস্তার ডিভাইডার ও ডিভাইডারের গাছপালার উপর জেদ মিটিয়েছেন। পবিত্র কোরআন পুড়িয়েছেন। আর এর দায়ভার দিয়েছেন হেফাজতের উপর। সেদিন হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে গায়েব করে রাখলেন। সমাবেশে যেতে দিলেন না। মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে জেলে পুড়ে তার ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছেন। অথচ তারা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু বিধির পরিবর্তন চেয়েছিলেন। আপনি করলেন কি তাদের চেহারাই পাল্টে দিলেন। ২০১৩ সালের ৫ই মে রাতে মতিঝিল এলাকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে তাদের চারদিক থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করলেন। এক সময় চারদিক থেকে একসঙ্গে তাদের ওপর গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড থেকে শুরু করে যত রকমের অস্ত্র আছে সবই ব্যবহার করলেন। মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকা হেফাজতের নেতাকর্মীদের রক্তে লাল হলো। সেদিন কতো শ’ নাকি হাজার মানুষ মারা গেছে তার সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। বরং কেউ কেউ এর সংখ্যা প্রকাশ করায় তাদের ওপর চলে নির্যাতন। দেয়া হয় মামলা। তাদের কাউকে জেল দেয়া হয়। কেউ কেউ বলেন, হিটলার তো ইহুদিদের মেরেছেন। আর আপনি মুসলমান হয়ে মুসলমানের রক্ত পান করেছেন। শুধু মুসলমানই নয়, নিজ দেশের জনগণের রক্ত চুষে খেয়েছেন। আপনার আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আপনার মুষ্টিবদ্ধ ছিল। তাই অনেকেই বাস্তবচিত্র তুলে ধরতে পারেনি। কতো না ভয় দেখিয়েছেন। কতো সাংবাদিককে জেলে পুড়েছেন। কতো সাংবাদিককে বহুদিন গুম করে রেখেছেন। কতো সাংবাদিক খুন হয়েছে আপনার আমলে- এসব হিসাব কি আছে? 


আপা, আপাগো, কি বলবো আপনাকে। আপনার কীর্তি অমর হয়ে থাকবে যুগে যুগে। মঙ্গলবার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গণহত্যার অভিযোগে আপনিসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর সভাপতি জুনায়েদ আল হাবিব ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কাছে এ অভিযোগ জমা দেন। এ সময় হেফাজতে ইসলামের নেতারা সাংবাদিকদের বলেন, আপনার আমলে এই গণহত্যার বিচার তো হয়নি, বরং তাদের সংগঠনের অনেক নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে বছরের পর বছর কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন করেছেন। এরমধ্যে জুনায়েদ আল হাবিবও রয়েছেন। তাকে মোদিবিরোধী আন্দোলনের অপরাধে গ্রেপ্তার করেছিলেন। আরে এক মামুনুল হককে কেন্দ্র করে যা করেছেন তাও ইতিহাসে বিরল। মাঝে মাঝে ভাবি এত বুদ্ধি নিয়ে আপনি চলেন কীভাবে। এত বুদ্ধি আপনার মাথায় আসে কীভাবে। আমার এক দাদা বলতেন- ঘুমানোর সময় বালিশ মাথার উপরে দিয়ে ঘুমালে নাকি বুদ্ধি বাড়ে। আপনি এমনটা করেন কিনা কে জানে। আরেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারীকে বলা হয়েছিল বেঁচে থাকতে হলে দেশ ছাড়তে হবে। এটা এখনই। আপনার ভয়ে মিজানুর রহমান আজহারী দেশ ছেড়েছিলেন। এরপর আপনি ক্ষমতায় থাকাকালীন আজহারী আর দেশে ফেরেননি। আপনি পালিয়ে যাবার পর আজহারী স্বাধীন দেশে বীরের বেশে দেশে আসেন। আপনি সব সময় বলতেন, দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। আপনার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা কি এ কথার প্রমাণ দেয়? 


ওগো আপা, আপনি পালিয়ে যাবার পর লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আনন্দ করে। উল্লাস করে। কিন্তু আমার মনটা এসব দেখে বিষণ্ন হয়ে পড়ে। কেন জানেন? আমি যে আপনাকে বড্ড শ্রদ্ধা করতাম। বীর ভাবতাম। কিন্তু বীর কি কখনো এমনভাবে কাউকে কিছু না বলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়? নাহ! আপা আজ আর কলম চলছে না। হাত অবশ হয়ে আসছে। এটাই বলবো, যেখানেই আছেন, ভালো থাকুন। দূর থেকে দেশের অমঙ্গল কামনা না করে মঙ্গল কামনা করবেন নিশ্চয়। 

মতামত'র অন্যান্য খবর