হতভাগার চিঠি ৮

মিষ্টি কথায় ভুইলা

শামীমুল হক | মতামত
ডিসেম্বর ৭, ২০২৪
মিষ্টি কথায় ভুইলা

প্রিয় হাসু আপা, নিশ্চয় মনে পড়ে ১৯৯৬ সালের কথা। ওই বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে পত্রিকায় একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। আপনি জায়নামাজে বসে দুই হাত উপরে তুলে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেন। সেই ছবি কয়েকদিনের মধ্যে পোস্টার হয়ে সারা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছিল আপনার সেই ছবি। আর এক ছবিতেই উল্টে যায় পরিস্থিতি। বাজিমাত করেন আপনি। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করে। আর আপনি হন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী। এরপর অনেক ঘটনা ঘটে। আপনার মন্দিরে গিয়ে দেবতাকে প্রণাম করার ছবিও দেখেছি। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশাল জয়ের পর আপনি যেসব মন্দ কাজ করেছেন তার অন্যতম একটি হলো-জামায়াতের নামে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন। মুসলমান মানে মাওলানাদের ওপর নির্মম অত্যাচার। এটি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে- দেশে ওয়াজ মাহফিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে থাকে। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানরা হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু। হায়রে নিয়তি। এরই মধ্যে শর্তসাপেক্ষে দুই একটি ওয়াজের অনুমতি স্থানীয় প্রশাসন দিলেও সেখানে আপনার দলের নেতা নামের গুণ্ডারা গিয়ে বাধা দেয়ার দৃশ্য দেশবাসী দেখেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আপনার আসল চেহারা তখন ভেসে উঠে। 


এ মুহূর্তে একটি গান মনে পড়েছে হাসু আপা। সেটা না বললেই নয়। মিষ্টি কথায় ভুইলা তুমি/আসল পিরিত চিনলানা/কাঁটার আঘাত দিলা বন্ধু/ ফুল তো কভু দিলা না/অন্তরেতে দাগ লাগাইয়ারে/বন্ধু আমার রইলা না/ কলিজা পুড়াইয়া গেলারে/বন্ধু আমার হইলা না...। ঠিক তাই কলিজা পুড়ে এখন অঙ্গার মুসলমানদের। বাংলাদেশে মোদির আগমনের প্রতিবাদে যখন কিছু ইসলামী দল বিক্ষোভ প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনার পুলিশ বাহিনী। আপনার নির্দেশে একের পর এক গ্রেপ্তার হতে থাকে দেশের প্রথম সারির ওয়াজেনরা। কারণ তারা আপনার নেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ওয়াজ করে। এরা কোরআনের ব্যাখ্যা দিতে থাকে। যার সবই আপনার বিরুদ্ধে যায়। তাদের মুখ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে সোনারগাঁ রয়েল রিসোর্টে যে কাণ্ড করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। কেন গো আপা, কেন এমন করতে গেলেন? কার বুদ্ধিতে করতে গেলেন? এতে আপনার আপাত লাভ হয়েছে ঠিকই কিন্তু আখেরে এ দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। দেশ ছেড়ে পালায় কারা? সেটা তো জানেনই। যারা দেশের দুশমন। আপনি নিজেকে বাংলাদেশের দুশমন ভাবতেন বলেই ৫ই আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সত্যিকারের বীররা জীবনের ভয় করে না। আপনি বীর হতে পারেন নি। হয়েছেন ভিলেন। সে সময় দাড়ি-টুপি দেখলেই পুলিশ ধাওয়া দিতো। আপনার চ্যালা-চামুণ্ডারা বলতো রাজাকার, নয়তো জামায়াত-শিবির। গোটা দেশটাকে এক নরকে পরিণত করেছিলেন। দাড়ি-টুপিওয়ালারা ভয়ে ভয়ে ঘর থেকে বের হতেন। আপা, কতো জাদু দেখেছি আপনার। মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী যাকে শিশু বক্তা বলা হতো এক সময়- তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। আদালতে তোলার সময় তার পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি, হাতে হাতকড়া কারও দৃষ্টি এড়ায়নি। এই ছোট্ট একটা মানুষকে আপনার এত ভয়। ওহ! ভুলেই গেছি। ওদের তো আবার জঙ্গি আখ্যা দিয়েছিলেন আপনি। এ কারণেই এত ভয় সেটা এতক্ষণে বুঝলাম। দেখুন না, আরেক জঙ্গি মুফতি আমির হামজা। তাকেও চার দেয়ালে বন্দি করে ফেললেন। মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর কী হাল করেছিলেন তা তো আপনি নিজেই জানেন। তাকে প্রায় পঙ্গু করে ছেড়েছিলেন। জেলখানার নির্যাতন তার শরীরে সয়নি। তাই তো জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বেশিদিন আর এই পৃথিবীর আলো দেখেন নি। মৃত্যুর আগে আপনার জন্য নিশ্চয় দুই হাত ভরে দোয়া করে গেছেন। যে দোয়ার বরকতে আপনি এখন ভাগ্যবান মানুষ। যার কোনো রাষ্ট্র নেই। রাষ্ট্রহীন এক মানুষ। এমন ভাগ্য ক’জনের আছে বলুন তো। পৃথিবীর হাতেগোনা ক’জন মানুষ এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মেছেন। আর জঙ্গি বলে দেশে কিছু আছে বলে এখন আমার মনে হচ্ছে না। কারণ জঙ্গি নাটক ছিল আপনার একটি কৌশল। যেমন কৌশল ছিল বিএনপি-জামায়াত, শিবির, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। এসবই ছিল আপনার ক্ষমতার থাকার একেকটি কৌশল। কিন্তু এখন সব কৌশলের খেলাই তো শেষ। এখন কোন কার্ড দিয়ে খেলবেন। মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবকেও ছাড়লেন না। যার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো শ্রোতারা। আপা, আপনি কি শুধু গ্রেপ্তার, নির্যাতন, মামলা দিয়েই সেরেছেন? বছরের পর বছর জামিন না দেয়ার নির্দেশদাতাও  ছিলেন আপনি। কী লাভ হয়েছে আপা? তারা এখন প্রশ্ন তুলছেন কেন আপনি এত মুসলিম বিদ্বেষী? এর কি কোনো গোপন কারণ আছে? কেউ কেউ বলছেন, বঙ্গবন্ধু একজন কন্যা রেখে গেছেন। যার হাত ধরে আওয়ামী লীগের ধ্বংস হয়ে গেছে। এ আওয়ামী লীগ এক সময় মুসলিম লীগের চেয়েও খারাপ হবে। কী হবে জানি না। ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু এসব শুনলে আপা কলিজাটা ছিঁড়ে যায়। মোচড় দিয়ে উঠে। কারণ ষোল বছরে আপনার কৌশল দেখে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। অন্য কিছু গ্রহণ করতে সময় লাগবে দেশবাসীর। এ সুযোগটি কি কাজে লাগাচ্ছেন আপা। দেশকে অস্থিতিশীল করে আপনি কী মজা পান। খুব জানতে ইচ্ছে করে। যাই হোক ষোল বছরে ইসলামকে কোণঠাসা করার সকল প্রয়াস নিয়েও আপনি হেরে গেলেন। আফসোস হয় আপনার জন্য। কে ভেবেছিল, এত সহজে আপনি দেশ ছেড়ে পালাবেন। কে ভেবেছিল আপনি ইসলামী বক্তাদের যেভাবে জেলে পুরেছেন আপনাকে একদিন ভিনদেশে বন্দি জীবন কাটাতে হবে? 
আপা, আপাগো খুব কষ্ট হচ্ছে-আপনার এই দুর্গতি দেখে। কেন আপনি বারবার বলতে গেলেন এ দেশ আমার বাবা স্বাধীন করেছে। এদেশ আমার বাবার। এদেশ ছেড়ে কোথাও পালাবো না। এখানেও তো কথা রাখতে পারেননি। আসলে আপা আপনার জীবনটা শুধু শূন্যের উপর ভাসছে। যেমন সংসদে দাঁড়িয়ে আপনি বলেছিলেন- আমার ছেলের বউ ইহুদি নয়। সে খ্রিষ্টান। আর খ্রিষ্টান মানে আহলে কিতাব। আপনি পক্ষান্তরে বলতে চেয়েছেন, আহলে কিতাবও মুসলমানের বাইরে নয়। আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। 
আজ এখানেই ইতি টানছি। আপা, মহান আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুক। শান্তিতে রাখুক। শেষ কথা বলবো- বাকি জীবনটা দুশ্চিন্তা না করে হেসে খেলে কাটিয়ে দিন। দেখবেন সামনে সব ফক্‌ফকা। 

মতামত'র অন্যান্য খবর