হ ত ভা গা র চি ঠি ১০

সেই কান্না দেখি না কতোদিন

শামীমুল হক | মতামত
ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
সেই কান্না দেখি  না কতোদিন

প্রিয় হাসু আপা, মিরপুর-১০ ও শেওড়াপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার পর তীব্র আন্দোলনের মধ্যেও স্টেশনটি দেখতে গিয়েছিলেন আপনি। সেখানে গিয়ে দরজা, জানালার কাঁচ ভাঙা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন। এটাই ছিল বাংলাদেশে আপনার শেষ কান্না। কিন্তু এ কান্না নিয়ে শুরু হয় সারা দেশে ট্রল। মানুষ বলতে থাকে, রাজপথের আন্দোলনে শত শত মানুষ-ছাত্র-পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে- এতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার কোনো মাথাব্যথা নেই। আসলে মেট্রোরেলে হামলার জন্য আপনার এ কান্না মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। অবশ্য গত ষোল বছরের শাসনামলে কতো লাখ বার যে আপনি সভা-সমাবেশে কেঁদেছেন- এর কোনো ইয়ত্তা নেই। তাই তো আমজনতা বলতে থাকে, এত কান্না আসে কোথা থেকে? কেউ কেউ বলেন, আপনি নাকি কাঁদার আগে চোখে গ্লিসারিন দিয়ে নেন। গ্লিসারিনের প্রভাবে চোখ দিয়ে এমনিতেই পানি পড়তে থাকে। আর কান্নার যে রূপ সেটা আপনার অভিনয়। যদিও আমি কখনো মানুষের এসব কথা বিশ্বাস করিনি। এ নিয়ে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তর্কও হয়েছে আমার। তাদের কথা-আপনার হাতে থাকা রুমালে মেডিসিন আগে থেকে মিশানো থাকে। কান্নার সময় এলে আগে রুমাল দিয়ে চোখের উপর একটা টান দেন। আর মুখে ওই ভাষণ শুরু করেন। জীবনে আমি সব হারিয়েছি। আমার আর হারাবার কিছু নেই। আমি আপনাদের নিয়ে থাকতে চাই। এ সময় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। অডিয়েন্স একেবারে নীরব নিথর হয়ে যায়। 


আপা, আপাগো, মনে পড়ে সেদিনের কথা? ইলিয়াস আলী গুমের ক’দিন পর আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ইলিয়াসপত্নী লুনা। গণভবনে আপনি তাদের জড়িয়ে ধরেছিলেন। চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা পানিও ঝরিয়েছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে সর্বোচ্চটা করবেন। সেদিনের চোখের পানিও কি সত্যিকারের ছিল। আপা, বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় আপনার সম্পৃক্ততা পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম সংক্রান্ত কমিশন। আপনি ছাড়াও আপনার প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে আপনার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও আপনার প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে; যাদের মধ্যে রয়েছেন আপনার প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ। কমিশন প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছে যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন ফোর্স নিজেদের মধ্যে ভিকটিম বিনিময় করেছে এবং পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্নভাবে বাস্তবায়ন করেছে। গুমের শিকার অনেকে এখনো শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। তাদের ওপর এতটাই ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল যে, তারা এখনো ট্রমায় ভুগছেন। কতো মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে। প্রতি বছর গুম দিবসে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার এক হয়। তাদের কান্নায় আকাশ ফেটে যাওয়ার অবস্থা। একজন সন্তান তার বাবাকে বাবা বলে ডাকার অপেক্ষায়। কিন্তু সে জানে না তার বাবা বেঁচে আছে কিনা। নাকি তাকে আপনার বাহিনী মেরে ফেলেছে। তারা আজীবন হয়তো এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বেঁচে থাকবেন। আপনি কথায় কথায় বলতেন স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি। কিন্তু বাস্তবে কতো স্বজনকে যে এতিম করেছেন তার হিসাব আছে কী? সেদিন একটি টেলিভিশনে এক মা তার পুত্র গুমের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, হাসিনা তার পিতা-মাতা, ভাই হারিয়েছেন। কিন্তু সন্তান হারাননি। তাই তিনি সন্তান হারানোর বেদনা বুঝবেন না। গুমের শিকার কতো মানুষকে আয়নাঘরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছেন নিশ্চয় আপনার কাছে হিসাব আছে। তাদের স্বজনদের আহাজারি আর দীর্ঘশ্বাস সৃষ্টিকর্তা হয়তো সহ্য করতে পারেনি। গোটা দেশটাকে এক নরকপুরী বানিয়ে ছেড়েছিলেন আপনি। আর না হয়, সামান্য কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে আপনাকে দেশ ছেড়ে যেতে হলো। পিচ্চি পিচ্চি এই ছেলেমেয়েদের কাছে আপনার মতো লৌহমানবী, নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচার এভাবে পরাজিত হতে হবে কে জানতো। আপনি যেদিন দেশ ছেড়েছেন সেদিন দেশের নারী, পুরুষ, কন্যা, জায়া, জননী, ছোট্ট শিশু, শত বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত রাজপথে নেমে আসে। তারা সেদিন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন। সেই ৫ই আগস্টও আপনি শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছেন। আপনি যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখনো আপনার পুলিশ বাহিনী ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি করছিল। রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছিল ছাত্র-জনতা। আপনি নিশ্চয় তখন নিরাপদে দেশের সীমানা পেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। আচ্ছা আপা, জানতে ইচ্ছা করে সেদিন কি আপনার চোখ দিয়ে সত্যিকারের পানি বেরিয়েছিল? আপনি কি কেঁদেছিলেন? আপা, বিএনপি, জামায়াতসহ সকল দলকে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন আপনি- আপনার কৌশল দিয়ে। রাস্তায় নামলেই গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডসহ সকল অস্ত্র প্রয়োগ করতো আপনার বাহিনী। আর বিরোধী দল কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলেই আপনি আপনার নেতাদের দিয়ে শান্তি সমাবেশের ডাক দেয়াতেন। ওই শান্তি সমাবেশে সবার হাতে থাকতো লাঠি। ওদিকে বিরোধী দলগুলো খালি হাতে রাস্তায় নামতো। খালি হাতকে এত ভয় কেন গো আপা? আপনি ও আপনার দলের নেতাকর্মীদের অপকর্ম, দুর্নীতি, নির্যাতন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, আপনি এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। শেষদিকে শুধু মুখে হম্বিতম্বিই ছিল সম্বল। আর যখন হম্বিতম্বিও শেষ হয়ে গেল তখন বিশ্বে রেকর্ড গড়ে আপনি পালালেন। এটা হলো আপা। দেশে থেকে আপনি জেল খাটতেন? আপনার নেতাদের কাউকে কিছু না বলে এমনভাবে পালাবেন- কেউ কল্পনাও করেনি। তাই তো আপনার দলের নেতাকর্মীরাও গা-ঢাকা দেয়। এমপি-মন্ত্রীরা আত্মগোপনে চলে যায়। যদিও কেউ কেউ পরে গ্রেপ্তার হয়েছে। এখন তারা কারাগারে রয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে আপনিসহ আপনার সহযোগীদের বিচার কার্যক্রম চলছে। জানেন আপা, আপনি যে ড. ইউনূসকে পানিতে চুবাতে চেয়েছিলেন সেই ইউনূসই এখন আপনাকে পানিতে চুবাচ্ছে। এটাই বুঝি আপনার জন্য নিয়তি ছিল। আপনার পথ ধরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টও দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু দেখেন তিনি একাই গিয়েছেন। তার সভাসদরা কিন্তু সিরিয়াতেই রয়েছেন। এতেও কিন্তু প্রমাণিত হয় আপনিই সেরা। আপনি দেশ ছেড়েছেন ঠিক আছে। অন্য দেশে থেকে ভার্চ্যুয়ালি লন্ডন-আমেরিকায় বক্তব্য দিয়ে কী বুঝাতে চাইছেন? আপনি যে এখনো শক্তিশালী- সেটা কি বুঝাতে চাইছেন? ইস্‌, এটা দেশের মানুষ বুঝে গেছে। আর বুঝাতে হবে না। আপনার ন্যূনতম ইজ্জত থাকলে একেবারে নীরব হয়ে যেতেন। সময় সুযোগ মতো সরব হতেন। আপনি গরম গরম খেতে চান সবকিছু। গরম কিছু খেলে জিহ্বা পুড়ে যায়- এ জিনিসটাও ভুলে গেলেন? আপনার উচিত দেশে থাকা আপনার নেতাকর্মীদের বলা- ভালো হয়ে যাও। এমন ব্যবহার করো মানুষ যেন তোমাদের দিকে আবার ভালোবাসার জাল ফেলে। পেছনে যা করেছো তার জন্য ক্ষমা চাও। বাঙালি বড় নরম মনের মানুষ। তাদের সামনে একটু হাসি দিয়ে কথা বললেই তারা গলে যায়। তারা টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত কিছুই চায় না। এই জিনিসটা আপনি নিশ্চয় ভালো করে জানতেন। এটাও জানতেন- আপনার দলের নেতাকর্মীরা দেশটাকে চুষে খেয়েছে। ব্যাংক খালি করে গেছে। ফুটপাথ থেকে আলিশান ভবন পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আপনার চোখের সামনে এভাবে দেশ ধ্বংস হচ্ছে দেখেও কি আপনি সত্যিকারের কান্না করতে পারলেন না। আপা, সবশেষে বলবো, দুঃখে কাঁদতে শিখুন। আনন্দে হাসতে শিখুন। অন্যের ওপর জুলুম করে কান্নার ভাব ঝেড়ে ফেলে দিন। হৃদয় থেকে যে কান্না সেই কান্না অন্যকেও কাঁদায়। কিন্তু আপনার কান্না অন্য কাউকে কাঁদাতো না। আপনি মঞ্চে একাই চোখের পানি ফেলতেন। মিনিট খানিক পরে পানি শুকিয়ে যেতো। আর তখনই বিরোধী দলগুলোকে যত পারেন গালমন্দ করতেন। এখন সময় এসেছে আপনার। ভুলের খাতা নিয়ে বসুন। এক, দুই, তিন, চার করে লিখতে থাকুন। সঙ্গে কাঁদতে শিখুন। কাঁদুন আপা- কাঁদুন। 
আজ এ পর্যন্তই। যে অবস্থায়ই থাকুন। ভালো থাকুন। 

মতামত'র অন্যান্য খবর