‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ করেও ২০২৫ এ নির্বাচন সম্ভব

মাসুদ কামাল | মতামত
ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ করেও ২০২৫ এ নির্বাচন সম্ভব

জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে? আমার ধারণা এটাই বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন। গত কয়েক মাস আকারে-ইঙ্গিতে এ বিষয়টি জানতে চেয়েছেন অনেকে। কিন্তু কোনো জবাব মেলেনি। এবার, গত কয়েকদিন ধরে অনেকটা সরাসরিই প্রশ্নটি উচ্চারিত হতে শুরু করেছে। এরপরও কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো উত্তর আসেনি। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে অনেক কথার মধ্যে নির্বাচনের বিষয়েও তিনি একটা ধারণা মাত্র দিয়েছেন। 
 

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, নির্বাচন ২০২৫ এর শেষদিকে কিংবা ২০২৬ এর প্রথমার্ধে হতে পারে। তিনি এর একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাড়া দেয়, অল্পকিছু সংস্কার করেই নির্বাচন করতে চায়, তাহলে ২০২৫ এর ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন হতে পারে। আর প্রত্যাশিত মাত্রায় সংস্কার করে তারপর নির্বাচন চাইলে সেটা আরও ছয় মাস পিছিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ২০২৬ এর প্রথমার্ধে হতে পারে নির্বাচন। 
 

প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যকে আসলে ‘অস্পষ্ট’ই বলা যায়। সময়ের বিষয়ে এখানে কিছু ধারণার কথা আছে, সম্ভাবনার কথা আছে। বেশকিছু ‘যদি’ আছে, ‘কিন্তু’ আছে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বেশ আগে থেকেই নির্বাচনের রোডম্যাপের কথা বলছিল। সরকারকে বলছিল- একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। কেউ কেউ আবার তাদের এমন চাওয়ায় স্পষ্টত বিরক্তই হচ্ছিল। বলছিল- এরা দেখি নির্বাচনের জন্য পাগল হয়ে গেছে!
 

আমি বুঝতে পারি না, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচন চায়, এতে দোষটা কোথায়? নির্বাচন হবে না, তাহলে দেশটা কি অনির্বাচিত সরকার চালাবে? অনির্দিষ্টকাল ধরে এমন একটা সরকার চালাবে, যাদেরকে জনগণ নির্বাচন করেনি। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এটা গণঅভ্যুত্থানের সরকার। তাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে আমি মোটেই একমত নই। আন্দোলনটা হয়েছিল হাসিনা সরকারের পতনের জন্য। নূরজাহান বেগম, বিধান রঞ্জন রায়, শারমিন মুরশিদ, সুপ্রদীপ চাকমা, শেখ বশির উদ্দিনদেরকে মন্ত্রী বানানোর জন্য নয়। হঠাৎ করেই, র‌্যানডমলি, যে পাঁচটি নাম আমি এখানে উল্লেখ করলাম, হাইপোথেটিক্যালি ধরুন, আন্দোলনের সময় যদি বলা হতো, ‘আন্দোলন সফল হলো এই লোকগুলো দেশ চালাবে’- একবার ভাবুন কী প্রতিক্রিয়া হতো! কেবল এই পাঁচজনই বা কেন পুরো উপদেষ্টামণ্ডলীর ৮০ শতাংশেরই শারীরিক বা মানসিকভাবে বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল না এই আন্দোলনে। তাহলে সেই উপদেষ্টা পরিষদ কোন বিবেচনায় গণ-আন্দোলনের সরকার হয়? মোদ্দা কথা, এটা গণআন্দোলনের সরকার নয়, এটা ড. ইউনূসের সরকার। অনেকের ভাষায়- ‘এনজিওগ্রাম’ সরকার। এনজিও, চট্টগ্রাম ও গ্রামীণ-নির্ভর সরকার। 
 

কাজেই এই বাস্তবতায় যত দ্রুত সম্ভব জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সবচেয়ে প্রত্যাশিত। অবশ্য এ কথা সত্য যে, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সাধারণ মানুষের মনে রাজনৈতিক সরকারের ব্যাপারে এক ধরনের অনীহা রয়েছে। জনগণের এমন অনীহার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও বেশ সচেতন। তারাও জানে, আগের মতো প্রচলিত ধারার রাজনীতি দিয়ে মানুষের সমর্থন আর পাওয়া যাবে না। তার প্রতিফলনও আমরা দেখছি। তারা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে, নতুন নতুন সংস্কারের কথা বলছে। বিএনপি’র মতো বড় দলও বলছে জাতীয় ঐক্যের সরকারের কথা। 
 

এখন প্রশ্ন উঠেছে সংস্কারের মাত্রা নিয়ে। পুরো সংস্কার নাকি আংশিক সংস্কার? আসলে পুরো সংস্কার কখনোই সম্ভব নয়, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা চলতে থাকবে। যেকোনো সংস্কার একবার করার পর আবারও সেটাকে সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা পড়তে পারে। তবে প্রধান উপদেষ্টার ভাষায়- ‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ বিষয়টা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলতে পারে। সাধারণ মানুষকে যদি এই দু’টি অপশন দেয়া হয়, তারা সবাই কিন্তু ‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ এর পরেই নির্বাচনের কথা বলবেন। সে হিসাবে, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের বিচারে ২০২৬ এর প্রথমার্ধ অর্থাৎ জুন মাসকে সময়সীমা হিসাবে ধরতে হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারিও কিন্তু পরদিন এ রকম কথাই বলেছেন। 
 

এখানে একটা জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে- প্রত্যাশিত সংস্কারের জন্য অত বেশি সময় লাগবে কেন? বিষয়টা নিয়ে আমি একটু আলোচনা করতে চাই। সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার প্রথমেই ৬টি কমিশন করেছে। যে কেউ বলবেন, এই ছয়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিনটি- সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা ও বিচার বিভাগ। আমার বিবেচনায় এই তিনটিতে যথাযথ সংস্কার করা গেলে বাকিগুলো এই তিনের প্রভাবেই লাইনে চলে আসবে। তারপরও ধরে নিই ওই ছয়টি সংস্কারই প্রত্যাশিত সংস্কার। সেক্ষেত্রে একদফা সময় বাড়ানোর পর ২০২৫ এর জানুয়ারিতে এই ছয় কমিশনের রিপোর্ট দেয়ার কথা। এরপর এই রিপোর্ট নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ বসবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। যাচাই-বাছাই করবে। কতদিন লাগবে সে কাজে? ধরা যাক তিন মাস। কিংবা যদি আরও একটু সময় দেন, তাহলে চার মাস। সে ক্ষেত্রে মে মাস নাগাদ সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে যাবে। এরপর আর কি বাকি থাকবে? ধরা যাক সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত, কিংবা ড্রাফটিং। সেজন্য আরও দুই মাস। জুলাই মাস নাগাদ সংস্কারের সবকিছু শেষ। তাহলে জুলাই মাসেও যদি নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হয়, তফশিল ঘোষণা করা হয়, তাহলে অক্টোবরেই নির্বাচন হতে পারে। জুলাইতেই তফশিল ঘোষণা সম্ভব এ কারণে যে, নির্বাচন কমিশন সূত্রে এরই মধ্যে জানা গেছে যে, তারা আগামী মার্চের মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে ফেলবে। ভোটার তালিকা আছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের আকাঙ্ক্ষা আছে, রাজনৈতিক দলগুলোও প্রস্তুত আছে, তাহলে নির্বাচনকে আরও আট মাস পিছিয়ে ২০২৬ এর জুনে নিতে হবে কেন? 
 

যে কথাটা বলে শেষ করতে চাই, মনে রাখতে হবে, ড. ইউনূসের সরকার স্থায়ীভাবে থাকতে আসেনি। উপদেষ্টাদের কারও কারও হয়তো ক্ষমতার ওই চেয়ারটা খুবই আরামদায়ক ঠেকতে পারে। কিন্তু তাদেরকেও মনে রাখতে হবে, এই চেয়ারে যারাই নির্ধারিত সময়ের বেশি থাকার চেষ্টা করেছে, তাদেরকেই বরণ করতে হয়েছে করুণ পরিণতি। 

 

মতামত'র অন্যান্য খবর