চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তার দেশে ফেরা নিয়ে চলছে নানাবিধ আলোচনা। ভাসছেন প্রশংসায়। আলোচনায় যুক্ত হচ্ছে আরও দুটি প্রশ্ন। কেন ফিরলেন না তারেক রহমান। রাজনীতিতে কী নাম লেখাতে যাচ্ছেন ডা. জুবাইদা রহমান। এর পাশাপাশি নো কনফিডেন্স মোশন মুভ হওয়ার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে সাবধান থাকতে বলছেন রাজনীতি বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ।
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন কাজী জেসিন। গাজী টিভি’র টাইমলাইন বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে- কোন পথে বিএনপি? এই শিরোনামে টকশোতে অংশ নিয়ে রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ এক প্রশ্নের জবাবে বেগম খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে বলেন, আমি তাকে বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের রানী বলি। দেশের মানুষ এখন আস্থা চায়। বাংলাদেশের মানুষ একটা অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করছে। যদিও ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছি; তারপরও দেশ কোন পথে এগুবে তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা চলছে। অনিশ্চিত যাত্রার মধ্যেও মানুষ ভরসা করতে চায় যিনি সকল রকম পরিস্থিতিতে আলোকবর্তিকার মতো পথ দেখাবেন। তবে আমি নিশ্চিত না তার রাজনীতি করার মতো স্বাস্থ্যের অবস্থা রয়েছে কিনা। তবে এটুকু বলতে পারি তিনি কয়েক মাস আগের তুলনায় ভালো বোধ করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, শেখ হাসিনার লক্ষ্য ছিল ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। সক্ষম না হলে ওনার পরিবারের কারও হাতে এই দায়িত্ব তুলে দিয়ে যাবেন। এখন প্রশ্ন উনি পারলেন না কেন? কম্বোডিয়ার হুনসেন সাকসেসফুলি ক্ষমতায় থাকলেন। এরপর ওনার ছেলের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে গেলেন। উনি পারলেন কারণ কোনো বিরোধী দল চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। ৫ই আগস্টের পর থেকে ক্রেডিট নিয়ে অনেক কথা চলছে। বেগম খালেদা জিয়ার স্বৈরাচার হটানোর ক্রেডিট নিয়ে কম আলোচনা করি। উনি কোনো ডিলে যান নাই। উনি ডিল করলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পারতেন। ওনার জীবন ঝুঁকিও ছিল। উনি তো দেশকে গোল্লায় দিয়ে ছেলের কাছে চলে যেতে পারতেন। তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনা ক্রমাগত বিএনপি’র এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কারণেই তাকে গুম, মানবধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত খুন, গায়েবি মামলা করতে হয়েছে। যেটা হয়নি কম্বোডিয়াতে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, শেখ হাসিনার ডিজাইন ছিল তিল তিল করে খালেদা জিয়াকে শেষ করে দেবেন। গত ১৫ বছর ওনার ওপর যেভাবে শেখ হাসিনা নির্যাতন করেছেন ওনার টিকে থাকাটাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তার ফিরে আসা কর্মীদের চাঙ্গা করে তুলবে। তিনি এখন রাজনীতির ঊর্ধ্বের একজন মানুষ।
খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান কী রাজনীতিতে আসবেন? জবাবে অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, এটার উত্তর দেয়ার মতো সময় হয়তো এখনো আসেনি। তবে আসলে খুব একটা খারাপ কিছু মনে হয় হবে না। তিনি উচ্চ শিক্ষিত, ব্যক্তিত্বের মধ্যে মোহনীয়তা আছে। যেটা তৃতীয় বিশ্বের জন্য জনগণকে আকর্ষণ করার জন্য খুবই প্রয়োজন। নেতৃত্ব দেয়ার মৌলিক গুণগুলো রয়েছে। তবে মাঠের রাজনীতি ভিন্ন। তিনি যদি সুষ্ঠুভাবে হাল ধরেন, সঠিকটা বেছে নিতে পারেন তাহলে ভালো করতে পারবেন।
তারেক রহমান কেন ফিরছেন না? এর জবাবে তিনি বলেন, যেহেতু তিনি একটা সময় বিদেশে অবস্থান করে রাজনীতিতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে গেছেন। এই দায়িত্ব ও দায় নিশ্চয়ই তিনি অনুভব করবেন। অনুভব করেন বলেই হয়তো তিনি আজ হোক, কাল হোক দেশে ফিরবেন।
একই প্রশ্নের জবাবে ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, বিএনপিকে নিয়ে সবসময় একটা অভিযোগ করা হয় যে, এটা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গঠন করা দল। এটা সত্য। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলেই দল তৈরি করা যায় না। এরশাদ তো পারেননি। বিএনপি দল হয়ে উঠেছিল প্রাথমিকভাবে যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন হয়। বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে। তারেক রহমান একটা অসাধ্য সাধন করেছেন এই দলটাকে ধরে রেখে। আমার অনুমান, তার আসা নিয়ে আবার একটা ক্রেজ তৈরি হবে। সেটা যদি নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সময় হয় তাহলে এটার একটা প্রভাব নির্বাচনে পড়বে।
সারোয়ার তুষার বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সহ সব রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন করেছিল। বিএনপি তখন তাদের দাবি মেনে নেয়। এগুলো বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বেসিক পার্থক্য। বিএনপি এখন বড় দল হিসেবে দেশের দায়িত্ব পালন করছে। আমরা সমালোচনা করছি; এটা মেনে নিয়েই রাজনীতি করতে হবে।
বিএনপি কোন পথে হাঁটবে? অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, বিএনপি সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেখানো গণতন্ত্রের পথেই হাঁটবে। এই পথে যদি বিএনপি চলে তাহলে বিএনপিকে পরাজিত করতে পারে এমন শক্তি দেখি না। কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্নে সাবধান থাকা উচিত।
বিএনপি এখন সংস্কার বনাম নির্বাচন এই বিতর্কে আছে। জাহেদ উর রহমান বলেন, এই বয়ানটা তৈরি করা হয়েছে। রাজনীতিতে বয়ান ম্যাটার করে। ভারতে দেখেন বিজেপি সরকারকে গো-রক্ষাকারী হিসেবে চেনে। মোদির সময় ভারত বিফ এক্সপোর্ট বাড়িয়েছে। বিএনপি’র সঙ্গে এনসিপি বা অন্যান্য দলের গুণগত মতপার্থক্য আছে। আমার সঙ্গেও আছে। এটাই তো হওয়া উচিত। বিএনপি সংস্কার চায় না এটা একটা ন্যারেটিভ। এটাকেও ভালোভাবে দেখি। এটা যদি ন্যারেটিভের যুদ্ধ হয় তাহলে চলাই উচিত। এনসিপিকে জায়গা তৈরি করতে চাইলে ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে কেন তুমি বিএনপিকে ভোট না দিয়ে আমাকে ভোট দেবে। তিনি বলেন, অনেকেই সংস্কার নিয়ে নেগেটিভ কথাও বলেছেন। যারা বলেছেন তারা কিন্তু সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত না। এটা নিয়ে আমারও দ্বিমত আছে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
বিএনপি সংস্কার চায় না শুধু নির্বাচন চায়, এটা এনসিপিও বলছে। সারোয়ার তুষার বলেন, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা কয়েকজন এমনভাবে কথা বলেছেন যে, তারা এটাকে কালক্ষেপণ মনে করছে। গুরুত্ব দিচ্ছে না। এসব মন্তব্য থেকে আশঙ্কা তৈরি হয়। আর সংস্কার কমিশনে বিএনপি’র যে ইনপুট এখানে বেসিক কিছু বিষয়ে বিএনপি এখনো বেঁকে আছে। ফলে ওই জিনিসগুলো না হলে শুধু উপরি সংস্কার হবে। কাঠামোগত সংস্কার হবে না। আমাদের ভাষায় মৌলিক সংস্কারগুলো হবে না। বিএনপি বলছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য করবো। কিন্তু কীভাবে করবে সেটা সুনির্দিষ্ট করেনি।
বন্দোবস্তের বিষয়ে অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, বন্দোবস্তের বিষয়টি প্রথম বলেছেন লন্ডন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মোসতাক খান। তিনি বলেছেন, বন্দোবস্ত তাৎক্ষণিকভাবে হয় না। সমাজের মধ্যে সার্বিকভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। এখানে মালিকের শক্তির পাশাপাশি শ্রমিকের শক্তি নাই। এটা ফিরে আসবে গণতন্ত্রের মাধ্যমে। এরজন্য সমাজে প্রচুর শক্তিশালী একটা দল হলে কাউন্টার দল থাকতে হবে। বাংলাদেশের কনটেক্স চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশের চারদিকে একটা রাষ্ট্র আছে। তিন দিক বলা হলেও এটা আমি চারদিক বলবো। এই রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপ করে চলবে। এখানে গণতন্ত্রের চর্চা করতে গেলেও সাবধানে করতে হবে। মালদ্বীপে মইজ্জু ক্ষমতায় এসেছিলেন ইন্ডিয়া আউট স্লোগান দিয়ে। মালদ্বীপের পার্লামেন্টে মইজ্জুর দল এবং বিরোধী দল সবাইকে কিনে মইজ্জুর বিরুদ্ধে নো কনফিডেন্স মোশন মুভ করে। এরকম অবস্থার সৃষ্টি কিন্তু বাংলাদেশেও হতে পারে। আমি কিন্তু বাংলাদেশকে প্রদেশে বিভক্ত করারও বিরোধী। বাংলাদেশকে যদি ভাগ করি একটা প্রদেশে এমন একটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে পারে। সেখানে স্থানীয় এমন কিছু ডিমান্ড করতে পারে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দিতে পারে। অতীতেও লক্ষ্য করেছি এজন্য খালেদা জিয়া পছন্দ করেননি। শেখ হাসিনাও করেননি। আমরা যাতে তাৎক্ষণিক আবেগের বশে সিদ্ধান্ত না নেই।
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি দেখা যাচ্ছে। এই প্রশ্নের জবাবে জাহেদ উর রহমান বলেন, আমি কোনো মেজর বিভাজন দেখি না। এখানে রিঅ্যাকশনটা ভায়োলেন্ট। এখন করণীয় গণতন্ত্রের চর্চাটাকে চলতে দেয়া। নির্বাচনকে ভায়োলেট না করা।
সরোয়ার তুষার বলেন, সংস্কার কতোটুকু নির্বাচনের আগে হবে; এরপর কিন্তু সংস্কার প্রক্রিয়া থেকেই যাবে।
গ্রন্থনা: পিয়াস সরকার