সংবিধান সংস্কার কমিশন অনেক পরিশ্রম করে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তার অনেকগুলোর সঙ্গে আমি একমত। তবে দুটো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। প্রথমত, মূলনীতি নতুনভাবে দাঁড় করাতে গিয়ে সেখান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এটা ঠিক যে, এই শব্দ না রেখেও একটি দেশ সব ধর্ম বিশ্বাস ও মতের মানুষকে ধারণ করার মতো গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করতে পারে। কিন্তু এই সংবিধান প্রস্তাব সেভাবে করা হয়নি। বরং এই শব্দ যে ধরনের যুক্তিতে বাদ দেয়া হয়েছে সেটাই সমস্যাজনক। বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে...এইটি বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সমাজের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়...।’ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে- রাষ্ট্র সব ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে, সব ধর্ম মতের মানুষকে ধারণ করবে। এতে কীভাবে ‘বিভক্তি ও বিভ্রান্তি’ তৈরি হয়? ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলে বহুত্ববাদ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক কী করে হয়?
গণ-অভ্যুত্থানকালে দেয়ালের গ্রাফিতিতে বহু জায়গায় বলা হয়েছে ‘ধর্ম যার যার দেশ সবার’। আমি মনে করি সেটাই ধর্মনিরপেক্ষতার সারকথা। শুধু অন্য ধর্মের মানুষ নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যেও বহু সংখ্যালঘু থাকে, ধর্মবোধে অনুশীলনে বহু পার্থক্য থাকতে পারে। তাদের সবার জন্যও নীতি-বিধিব্যবস্থা প্রণয়নে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনের আরও দাবি- এটি ‘অতীতে ফ্যাসিবাদী শাসনের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে’। বস্তুত উল্টো, সেই শাসন তৈরি হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রতারণা করে, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে, নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা জারি করে, মুক্তিযুদ্ধকে অপব্যবহার করে, এবং জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের ব্যবস্থা করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার উদগ্র বাসনায়। ভারতেও যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে নয়, তা পদদলিত করেই বিজেপি’র ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়েছে। সেখানে ২০ কোটি মুসলমান সহ সকল ধর্মের গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষেরা ধর্মনিরপেক্ষতা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠারই দাবি জানাচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, সংবিধানের মূলনীতি থেকে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটিও বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথম থেকেই ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ ছিল অলঙ্কার, দেশ চলেছে পুরোপুরি বিপরীত দিকে। ক্ষমতায় যারা ছিলেন, আছেন এবং আসবেন বলে আশা করছেন তাদের সবার জন্যই এই মূলনীতি খুবই অপ্রাসঙ্গিক এবং ভারী বোঝা। তাই এই শব্দ বাদ দেয়া অযৌক্তিক নয়। তবে এই অলঙ্কার বাদ দেয়ার জন্য যে যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে তা খুবই ভুল এবং সমস্যাজনক। বলা হয়েছে, ‘সমাজতন্ত্র মূলত গণতন্ত্রবিরোধী শাসনব্যবস্থা’ এবং ‘বৈশ্বিক এবং জাতীয় প্রেক্ষাপটে অপ্রাসঙ্গিক’। না, সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্র তুলনা হয় না। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করতে হবে পুঁজিবাদ আর গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করতে হবে স্বৈরতন্ত্রকে। পুঁজিবাদের যেমন নানা রকম মডেল আছে, সমাজতন্ত্রেরও বিভিন্ন ধরন আছে। বর্তমানে বহু দেশ আছে যেখানে বামপন্থি/সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত দলগুলো নির্বাচন করছে; ক্ষমতায়ও যাচ্ছে। যেমন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি। ইউরোপের বহু দেশে এরকম দলগুলোই গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণমূলক কর্মসূচি দিচ্ছে। উগ্র ডানপন্থি আক্রমণের মুখে শ্রমজীবী ও প্রবাসী মানুষেরা তাদের ভরসাতেই থাকেন।
বিপরীতে কমিশন ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র কথা বলেছেন। নাম ‘মুক্ত’ হলেও আসলে এটি কতিপয় গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত প্রাণবিনাশী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, উগ্র পুঁজিপন্থি কিছু গোষ্ঠী ছাড়া দুনিয়ার কেউ এটাকে আর কাঙ্ক্ষিত পথ বলে মনে করে না, ইউরোপ-আমেরিকাতেও নয়। এই পথ ধরলে এটাও বলতে হবে যে, ‘সাম্য’ ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ কথাগুলো আমরা রেখেছি অলঙ্কার হিসেবে। আর এটাও বলতে হবে যে, বৈষম্যহীনতার দিকে যাওয়ার পরিবর্তে বৈষম্য বৃদ্ধির দিকে যাওয়ার অর্থনীতিই অব্যাহত থাকবে। বলতে হবে এটাই ‘বৈশ্বিক এবং জাতীয় প্রেক্ষাপটে সবচাইতে প্রাসঙ্গিক’, দেয়ালের গ্রাফিতিতে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ নিয়ে সব ভুল প্রত্যাশা প্রকাশ করা হয়েছিল!