চব্বিশের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের বার্ষিকীর আয়োজন শুরু হয়েছে ১লা জুলাই। এই কর্মসূচি চলবে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু এসব কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকারও তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে খুব ভাবিত বলে মনে হয় না। অন্তত তাদের কাজকর্মে তার ছাপ কমই আছে বলতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাসের মাথায় এসে জনগণের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি সামনে এসেছে। গত ৯ই জুলাই পুরনো ঢাকায় যেই মধ্যযুগীয় কায়দায় লাল চান নামে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হলো, তাতে সারা দেশের মানুষ হতবাক হয়ে গেছে। একজন মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করে পাথর দিয়ে তার শরীর থেঁতলে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আশপাশের লোকজন তাকিয়ে দেখছিলেন, কেউ প্রতিবাদ করলেন না। অথচ এই মানুষই এক বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পেটোয়া বাহিনীকে রুখে দিয়েছে।
আবার এই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যেই মানসিক বৈকল্যের পরিচয় দিয়েছে, তা নজিরবিহীন। তারা জননিরাপত্তার বিষয়টি সামনে না এনে একে অপরকে অশালীন ভাষায় গালাগাল করতে থাকলো। অপরের মুখে কালিমা লেপন করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এক দল ইটপাটকেল মারে তো আরেক দল ধারালো ছুরি নিয়ে প্রস্তুত থাকে। গণ-অভ্যুত্থানের শরিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন ভাষা ব্যবহার করেছে, যা শুনলে যেকোনো রুচিবান মানুষই কানে আঙ্গুল দেবেন।
লাল চান হত্যার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চিরুনি অভিযান চালানোর কথা বললেও তার কোনো আলামত আমরা মাঠে দেখি না। প্রতিদিন খুন ধর্ষণ ডাকাতি ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে মবোক্রেসি বা সংঘবদ্ধ সহিংসতা।
সরকারের পক্ষ থেকে নতুন কোনো অভিযানের কথা বললে মানুষ আশ্বস্ত হয় না। শঙ্কিত হয়। থানা-পুলিশের বাণিজ্য বাড়ে। গত ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুরে একজন সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা চলাকালে স্থানীয়রা লুটপাটকারীদের আটকে রাখে। পরে তাদের উদ্ধার করতে সেনাবাহিনীকে যেতে হয়। এরপর সরকার অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু করে। প্রশ্ন হলো সেটি প্রকৃত ডেভিলদের ধরতে না রেহাই দিতে সেই প্রশ্ন করেছেন অনেকেই। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে, বিএনপি’র একজন দায়িত্বশীল নেতা হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আমরা চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি, পেয়েছি মবোক্রেসি।’ আইনের শাসন আর মবোক্রেসি একসঙ্গে চলতে পারে না।
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশকে কেন্দ্র করে মহাকাণ্ড ঘটলো। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনা তলব করতে হলো। ১৪৪ ধারা জারি করতে হলো। কারফিউ জারি করতে হলো। চারজন মানুষ গুলিতে মারা গেলেন। এনসিপি নেতাদের উদ্ধার করতে আর্মাড কার পাঠাতে হলো। কিন্তু সরকার আগে থেকে কিছু আঁচ করতে পারলো না। এসব নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বললেন, ‘গোয়েন্দাদের কাছে গোলযোগ হতে পারে বলে খবর ছিল। কিন্তু সেটা এত বড় হবে সেটা ধারণা করতে পারেনি।’ এই ব্যর্থতার দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এড়াবে কীভাবে? কোনো বড় ঘটনাই তো সরকার পুলিশ, র্যাব, বিজিবি নামিয়েও সামাল দিতে পারে না। সেনাবাহিনী তলব করতে হয়।
এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ। তারপরও তারা গোপালগঞ্জে প্রলয়কাণ্ড ঘটাতে পারলো কেন? এর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার কার উস্কানি ছিল তাও খতিয়ে দেখা দরকার। সারা দেশে এনসিপি দেশ জুড়ে জুলাই পদযাত্রা পালন করছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে সেটা ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হলো কেন? দুটোর অর্থ ও তাৎপর্য এক নয়। তাদের কর্মসূচিকে ঘিরে সেখানকার সাধারণ মানুষের যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল, সেটা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আমলে নিয়েছিলেন কিনা?
অনেকদিন আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগারদের ঘুম হারাম করে দেবেন, এখন দেখা যাচ্ছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাই সরকারের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। সরকার আগে থেকে সেখানকার মানুষের মনোভাব উপলব্ধি করতে পারলে উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়াতে পারতো। চারজন মানুষকে এভাবে গুলি খেয়ে মারা যেতে হতো না। সরকার এখন যেই ব্যাখ্যাই দিক না কেন এই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারবে না।
যেকোনো আলোচনা বা সংলাপ সফল হওয়ার জন্য পারস্পরিক আস্থা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বেশির ভাগ বিষয় যে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে, তার পেছনেও আছে আস্থার সংকট। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন ঐকমত্য কমিশন তথা সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দিহান, তেমনি তারা একে অপরকেও বিশ্বাস করে না। বেশির ভাগ দল নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে তৎপর, যার নেতিবাচক প্রভাব আমরা দেখি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে। যেই জুলাই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করার কথা, সেটা জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহেও চূড়ান্ত করা যায়নি। এখন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আর রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের ওপর ব্যর্থতার চায় চাপাতে চাইছে। এর অর্থ হলো গত বছর রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছিল সরকারের প্রতি, সেই সমর্থন আর তারা রাখতে পারছে না। নির্বাচন নিয়ে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন করেছেন তারা। তারা মনে করেন, সরকারের ভেতরে থাকা সরকারটি নির্বাচন দিতে চাইছে না। এ কারণেই ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলের দোলাচাল রেখে দিয়েছেন।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে যেই বিষয়টি দেশের অর্থনীতিতে বড় শঙ্কা তৈরি করেছে, সেটা হলো মার্কিন শুল্কনীতি। গত ৯ই এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক ধার্য করেন। বর্তমানে যে ১৫ শতাংশ শুল্ক আছে, এটা তার অতিরিক্ত। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশি পণ্যের মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫২ শতাংশ। সমপ্রতি প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা চিঠিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুল্কহার কমানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতেই দেরি করে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, চুক্তি করতে না পারার কারণ প্রস্তুতির ঘাটতি। শুল্ক বিরোধ নিয়ে আলোচনা করার কথা বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিনের। কিন্তু সরকার প্রথমে আলোচনার দায়িত্ব দেয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকীকে। ২১শে এপ্রিল ওয়াশিংটনে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের সঙ্গে তার বৈঠক হলেও সেটা সফল হয়নি। এরপর প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আলোচনা করেন ইউএসটিআরের সঙ্গে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। যদিও তিনি এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন যে, বাংলাদেশ অন্যদের থেকে এগিয়ে আছে। শেষ পর্যায়ে বাণিজ্য উপদেষ্টাকে এমন সময়ে দায়িত্ব দেয়া হয়, যখন ট্রাম্প প্রশাসন শুল্কের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বশেষ বৈঠকে আরও যে উদ্বেগজনক বিষয়টি বেরিয়ে আসে, তা হলো শুল্কের হার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। তারা ভূরাজনীতিতে তাদের প্রতিপক্ষ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেন কমাতে চায়। বিশেষ করে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ে প্রধানত চীনের ওপর নির্ভরশীল। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারত সেই নির্ভরতা কমানোর জন্য চাপ দিলেও খুব লাভ হয়নি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্তরের মাঝামাঝি সময় থেকেই চীনা সামরিক সরঞ্জামের ওপর নির্ভর করে আসছে। হঠাৎ করে সেটা বদলানোর সুযোগ কম।
সর্বশেষ খবর হলো বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য কিনতে আরও শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪টি বোয়িং ও ৩ লাখ টন গম কিনতেও রাজি হয়েছে। সমস্যা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় সরকার হ-য-ব-র-ল করে ফেলেছে। প্রশ্ন হলো একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে মার্কিন প্রস্তাব মেনে নেয়া সম্ভব কিনা। বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনে যেখানে চীন প্রধান ভরসা, সেখানে তাকে অসন্তুষ্ট করলে বাংলাদেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে কূটনীতিকরা মনে করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি কীভাবে সুরাহা করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তারা কি জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলবে না কোনো পক্ষকে খুশি করতে গিয়ে অন্য পক্ষের বিরাগভাজন হবে?