রাষ্ট্র যখন নিজের সর্বোচ্চ আদালতেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেটি শুধু একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা বা সাংবিধানিক বিভ্রান্তি নয়-প্রকৃতপক্ষে এটি জনগণের উপর্যুপরি মালিকানার বিরুদ্ধে এক সুপরিকল্পিত আঘাত, রাষ্ট্রচুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলোর অবমাননা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এমনই এক গভীর ও বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খাইরুল হক-যার মাধ্যমে তিনি ইতিহাসে রাষ্ট্রবিরোধী এক বিচারিক ক্যু-এর খলনায়ক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করিয়ে গেছেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ একটি চূড়ান্ত রায় প্রদান করেছিল-যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলেও পরবর্তী দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে সম্পন্ন করার নির্দেশ ছিল। খাইরুল হক সেই ফুল বেঞ্চের প্রধান ছিলেন। কিন্তু তিনি অবসরের পর বিচারিক ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও নিজ ঘরে বসে সেই রায়ের সিদ্ধান্ত মুছে দেন বা পাল্টে দেন, এটি শুধু বেআইনিই নয়, একেবারে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এই ঘটনা আদালতের রায়ের বৈধতা, বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সংবিধান রক্ষার কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির হাতে রাষ্ট্রঘাতী হস্তক্ষেপ যেমন অনভিপ্রেত, তেমনি তা ভবিষ্যতের জন্যও এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত।
কেন এটি রাষ্ট্রদ্রোহ: বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৪ (৪) ধারা অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা তার কার্যকালেই সীমাবদ্ধ। অবসরের পর তিনি সাধারণ নাগরিক। সেই অবস্থায় বিচারিক রায় পরিবর্তনের কোনো সাংবিধানিক অধিকার তার নেই। যদি তিনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষিত একটি চূড়ান্ত রায় ঘরে বসে বদলে দেন, তবে সেটি আর রায় নয়-রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আক্রমণ।
ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে। কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ায় আপিল বিভাগের পূর্ণ বেঞ্চের রায়ই ছিল চূড়ান্ত নিষ্পত্তি। সেই রায় এককভাবে বাতিল করা মানে প্রজাতন্ত্রের আইনি ভিত্তিকে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন করা। এটি শুধু আইন লঙ্ঘনই নয়, রাষ্ট্রের ভিতকেও চ্যালেঞ্জ করা। সংবিধান কিংবা সুপ্রিম কোর্ট-রুলস অনুযায়ী-অবসরপ্রাপ্ত বিচারক আদালতের অংশ নন, কাজেই তার দেয়া কোনো সিদ্ধান্ত বিচারিক রায় হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
রাষ্ট্রদ্রোহ কেবল অস্ত্র হাতে নেয়া নয়, রাষ্ট্র-কাঠামোর নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করাও রাষ্ট্রদ্রোহ। আর সেই ধ্বংস যদি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত থেকেই ঘটে, তবে তা আরও ভয়ঙ্কর। এতে ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াগত শুদ্ধতাও (Procedural fairness) লঙ্ঘিত হয়।
বিচারের নামে বিচারব্যবস্থার হত্যা: রায় (Judgment) হলো একটি বিচারাধীন মামলার চূড়ান্ত ও লিখিত নিষ্পত্তি, যা সাধারণত পূর্ণাঙ্গ আদালত (Full Bench) বা নির্ধারিত বিচারপতিদের বেঞ্চ শুনানির পর যুক্তি, তথ্যপ্রমাণ ও আইন-ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রদান করা হয় এটি চূড়ান্ত। এই রায় একবার উচ্চারিত হলে তা ব্যক্তি-বিচারকের সম্পত্তি থাকে না, সেটি হয়ে ওঠে প্রজাতন্ত্রের আইনি বক্তব্য।
বিচারপতি যদি অবসরের পর সে-সিদ্ধান্ত পাল্টে দেন, সেটি ব্যক্তিগত নয়-রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। এটি ‘রায় হত্যার’ নামান্তর। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় রিভিউ ছাড়া বদলানো যায় না।
কোনো প্রজাতন্ত্রে-কারও ব্যক্তিগত অধিকার নেই, চূড়ান্ত রায় পুনরায় লিখে দেয়ার। অবসরে গিয়ে বিচারপতি যদি ঘরে বসে রায়ের কবর খুঁড়ে দেন, তবে সেটা রায় নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থার হত্যা। এমন ঘটনা কেবল নজিরবিহীন নয়, তা ভবিষ্যতের জন্য বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ধ্বংসকারী এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত।
খাইরুল হকের সংবিধানবহির্ভূত কর্তৃত্বের কারণে, জনগণ হারিয়েছে ভোটাধিকারের সাংবিধানিক সুরক্ষা। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন পেয়েছে এক প্রহসনমূলক নৈতিক বৈধতা এবং অগণিত তরুণদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। পরিশেষে রাষ্ট্রকে গভীর সংকটে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
এই একটি বেআইনি আদেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ‘‘Justice must not only be done, but must also be seen to be done.” ন্যায়বিচার শুধু হওয়াই নয়, তা জনগণের কাছে দৃশ্যমান হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। বিচারিক ক্ষমতার এমন অবৈধ ও গোপনীয় অপব্যবহার বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা ধ্বংস করে। একজন বিচারক যখন অবসরের পর রায় পাল্টে দেন, তখন তা আদালতের শৃঙ্খলা নয়, এক ধরনের বিচারিক বিদ্রোহ। বিচারালয় কোনো ব্যক্তির বৈঠকখানা নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা, যেখানে বিচারক নিজেও আইন দ্বারা বাঁধা।
উচ্চতর আদালতের দায়িত্ব: খাইরুল হকের এই কাজ শুধু আদালত অবমাননা নয়-এটি সংবিধানের ৭ (১) ধারা লঙ্ঘনের মাধ্যমে জনগণের মালিকানার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। অথচ আজও তার এই রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের জন্য উচ্চতর আদালত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এটি শুধু বিচার বিভাগের অভিভাবকত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, রাষ্ট্রদ্রোহকে প্রশ্রয়ও দেয়। এমন পটভূমিতে উচ্চতর আদালতের কর্তব্য-একটি স্বাধীন বিচারিক কমিশন গঠন করে এই রায় ও সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত করা। কমিশনের লক্ষ্য হবে:-
১) খাইরুল হকের সংবিধান লঙ্ঘনের দায় নির্ধারণ করা।
২) ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশমালা প্রদান করা।
ন্যায়বিচার শুধু হওয়া নয়, দৃশ্যমান হওয়াও জরুরি। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক কর্তব্য সম্পাদন ও নৈতিকশক্তির প্রকাশ ঘটাতে হবে।
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com.