অতি সম্প্রতি একটি বহুল প্রচলিত ইংরেজি দৈনিকে বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্ত না হওয়ার যে কারণ বর্ণনা করা হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর। গত বেশ কিছু দিন যাবৎ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মন্দাভাব চলছে। এ নিয়ে অনেক সুধীজন, অনেক বয়ান করে চলেছেন। অবশ্য কয়েকদিন ধরে বাজার কিছুটা সক্রিয় হয়েছে। মনে করা হয় যে, বর্তমানে দেশের মেক্স অর্থনীতি কিছুটা সচল রয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে এই একজন প্রথম বাংলাদেশের গভর্নর হয়ে এসেছেন, যিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন এবং নিবেদিত। অবশ্য পূর্ণ মূল্যায়নের সময় হয়নি। তবে আমাদের প্রত্যাশা যে, তিনি সঠিক পথে থাকবেন। মূল বিষয় আসার আগে স্টক এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে কিছু কথা বলতে হয়। জন্মলগ্ন থেকে একদিকে যেমন পুঁজি সরবরাহের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে একই সঙ্গে মাঝে মাঝে শেয়ার কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে চলেছে। ১৭২০ সালে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ সাউথ সি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বিরাট কেলেঙ্কারি হয়। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন এই কোম্পানির শেয়ার কিনে ২০ হাজার পাউন্ড হারিয়ে ছিলেন। তখন তিনি নাকি দুঃখ করে বলেছিলেন- আমি গ্রহ নক্ষত্রের গতিকে পরিমাপ করা শিখলাম, কিন্তু শেয়ার বাজারের গতিকে বুঝতে পারলাম না।
যুক্তরাজ্যের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মি. ওয়াল পল বিপদে পড়তে গিয়েও অবশ্যই বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি তার শেয়ার আগেই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার চ্যান্সেলর বিপদে পড়েছিলেন। তার বিচার হয় তৎকালীন রীতি অনুযায়ী তাকে টাউয়ারে বন্দি করা হয়। এটি সম্ভব হয়েছিল এজন্য যে, শেয়ার কেলেঙ্কারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশ পার্লামেন্ট যৌথ তদন্ত কমিশন গঠন করেন এবং তারা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
বোধহয় এমন কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ নেই কোনো কোনো সময় স্ক্যাম হয়নি। গত শতাব্দীর শেষ অর্ধে আমরা দেখেছি ভারতের শেয়ার কেলেঙ্কারির সম্রাট হাসশ্যার মেহেতা জেলে যান এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। হংকং স্টক এক্সচেঞ্জ চেয়ারম্যানকে হাত করা পরিয়ে আইচো থেকে হংকং আনা হয়েছিল। অতি সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ আমাদের বিচারহীনতার ঐতিহ্যের কারণে অপরাধীর শাস্তি হয় না। উপরন্তু শেয়ারবাজারের দুর্নীতি ঘাঁটানোর নিত্যনতুন পথ আবিষ্কার হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২য় বৃহৎ শেয়ার কেলেঙ্কারিতে (২০০৯-২০১০) কিছু ব্যাংক গভীরভাবে কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিল। মরহুম বরেণ্য অর্থনীতিবিদ জনাব ইব্রাহিম খালেদ তার প্রতিবেদনে লিখেছিলেন যে, বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকে দুপুরে কোনো কর্মকাণ্ড হতো না; সবাই হুমড়ি খেয়ে শেয়ার বিলবোর্ডের দিকে পড়ে থাকতেন। যাই হোক আমাদের প্রত্যাশা আগামীতে আমরা এই সব অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকবো।
এখন মূল আলোচনায় আসি। বলা হয়েছে যে, বহুজাতিক কোম্পানির না আসার অন্যতম কারণ পরিচালনা পর্ষদে নিরপেক্ষ পরিচালকের অবস্থান। তালিকাভুক্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বোর্ডে নিরপেক্ষ পরিচালক থাকতে হবে এই ধারণা তথা নির্দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। যে দেশটি উদার অর্থনীতির প্রধান প্রবক্তা। আমরা জানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মহা বিপর্যয় তথা টুইন টাওয়ার ধ্বংস করা হয় লাদেন বাহিনী দ্বারা। নির্মম পরিহাস যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একই সময়ে পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ এনার্জি কোম্পানি এবরন কোম্পানি সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়। এর সঙ্গে ডুবে যায় বিশ্বের পাঁচটি বৃহৎ অডিট ফার্মের অন্যতম আর্থার এন্ডারসান অডিট ফার্ম। এর অল্প দিনের ভেতর আটলান্টিকের অপর প্রান্তে কয়েকটি কোম্পানির মৃত্যু ঘটে। এখানে উল্লেখ্য যে, এবরনকে আদর্শ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির রোল মডেল গণ্য করা হতো।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অতি দ্রুত সারব্যান্স অক্সিলি অ্যাক্ট পাস করা হয়। এখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রত্যেকটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিচালনা পর্ষদে প্রয়োজন মতো নিরপেক্ষ পরিচালক রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে কোম্পানির কোনো রকম আর্থিক লেনদেন থাকবে না। এবং তারা কোনো কোম্পানির শেয়ার ধারণ করতে পারবে না। এতদিন চার্টার অডিট ফার্ম যে অডিট রিপোর্ট প্রদান করতো কোম্পানি সেটাকে চূড়ান্ত হিসাবে গ্রহণ করতো। এখন আইন করা হলো যে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির অডিট নিরীক্ষা করার জন্য পৃথক কর্তৃপক্ষ থাকবে।
আরেকটি কথা বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে কর্পোরেট ট্যাক্সের আর বেশি এবং বহুজাতিক কোম্পানির জন্য একই হার প্রযোজ্য। বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য কর্পোরেট ট্যাক্সের হার শতকরা ২৭.৫%। সুধীজন বলে থাকেন যে, ইউরোপে বিভিন্ন দেশে কোম্পানির হার শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ। কিন্তু তারা এটা উল্লেখ করে না এই সব কোম্পানিকে কমপক্ষে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর প্রদান করতে হয়। ডাবল ট্যাক্সের কথা বলা হয়ে থাকে বিশেষ করে আইসিবি’র মিউচুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে যে, আইসিবি এর উপর তো ট্যাক্স দিয়েছে। যিনি এই লভ্যাংশ পেয়েছেন তিনিও বিনিয়োগ করেছেন। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ লভ্যাংশ অতিক্রম করায় তাকে কর দিতে হয়। এটি তার আয়ের কর। একজন তার আয়ের কর দেয়ার পর ১৪ পুরুষ কর দিবে না- এটা তো হতে পারে না। এক আমেরিকান নাগরিক কর প্রদান সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ট্যাক্স এবং মৃত্যু তুমি এড়াতে পারো না।
বিও অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের সংখ্যা আনুমানিক ১৭ লাখ অর্থাৎ শতকরা ১ ভাগ মানুষ শেয়ারবাজারের সঙ্গে জড়িত। মূলত শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করতে হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। এর জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভেতরে আগ্রহ তৈরি করতে হবে এবং আকৃষ্ট করতে হবে। এক সময় বাংলাদেশের আইপিও মার্কেটকে বলা হতো স্বর্ণখনি। প্রচুর সাধারণ বিনিয়োগকারী ছিলেন। এমনকি অনেক গৃহিণীও। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটো বড় শেয়ার বিপর্যয় ঘটে। এতে সহজ সরল অনেক বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়েছেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার অন্যতম পথ হলো ব্যাপক ভাবে আইপিও মাধ্যমে শেয়ার ছাড়া। আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারী অবশ্যই চাইবো কিন্তু আমাদের দেশেও ইতিমধ্যে গ্রুপ অফ কোম্পানি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রত্যেকেই দু’একটির বেশি কোম্পানির শেয়ার আইপিও মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করছে না। স্টক এক্সচেঞ্জের গল্পই হলো যে তারা বিনা সুদে কোম্পানির জন্য পুঁজি সরবরাহ করে থাকে আইপিও এর মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না। এটা তো ঠিক যে, শেয়ারবাজারে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন এবরন ডুবে যাওয়ার ফলে তার কোম্পানির কর্মচারীদের পেনশন ফান্ডও ডুবে যায়। তবে মনে রাখতে হবে আইপিও মার্কেটে বিনিয়োগ তখনই হারিয়ে যাবে যখন কোম্পানি বিপদগ্রস্ত কিংবা অন্য কোনো বির্পয়ের মুখে পড়বে।
পরিশেষে শেয়ারবাজারে আসতে গেলে কয়েকটি কথা সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে। প্রথমত একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোনো ঋণের টাকায় শেয়ার কেনা সঠিক হবে না। তবে মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বিনিয়োগ ভিন্ন কথা। কেননা, সেখানে বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা হয়, যা বিনিয়োগকে রক্ষা করবে। আর একটি কথা চালু আছে সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে নেই, অর্থাৎ সহজ কথায় বলা যায় এক কোম্পানিতে নিজের সব অর্থ বিনিয়োগ করবেন না।