হ ত ভা গা র চি ঠি ২৭

কখনো কি ভেবেছিলেন আপা?

শামীমুল হক | মতামত
আগস্ট ৩০, ২০২৫
কখনো কি  ভেবেছিলেন আপা?

সম্প্রতি একটি গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘বন্ধু কি পিরিতি শিখাইলা/ আমার হইলো নেশা/ এখন শুধু ভালো লাগে/ তোমার ভালোবাসা/ আমার হইলো নেশা...। সত্যিই পৃথিবীটা ভালোবাসা আর নেশার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু ভালোবাসার যে কতো রূপ এরমধ্যে যে না পড়েছে সে বুঝবে কী করে? আর নেশা সে তো জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। নেশা কতো রকমের হয়? এই যে ধরুন কারও ক্ষমতার নেশা। সেটা যে ক্ষমতাই হউক। রাজসিংহাসন কিংবা অতিমূল্যবান কোনো কেদারা। যে কেদারায় বসে হুংকার দেয়া যায়। 
সুপ্রিয় হাসু আপা, নিশ্চয় এখন আপনার মন ফুরফুরে মেজাজে আছে। রাজসিংহাসনে না থাকলেও একটি কেদারা তো পেয়েছেন? যেখানে বসে যখন তখন হুংকার দিতে পারছেন। নেতাকর্মীদের কৌশল বাতলে দিতে পারছেন। আপনার এই কৌশল যে কাজে লাগছে- তা কিন্তু একদিনে টের পাওয়া যাচ্ছে। এই তো সেদিন গুলিস্তানে আপনার দলের ঝটিকা মিছিল হয়ে গেল। আবার এখানে ওখানে আপনার ভক্তরা আপনার কথা অনুযায়ী নানা কাজ, অকাজ করছে। এসব দেখে মনে হয় দেশ থেকে রাজসিংহাসন ছেড়ে পালালেও আপনি একজন সাকসেসম্যান। ভিনদেশের কোনো কেদারায় বসে কি বলছেন তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। এতে আপনার নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আপনার কোনো বক্তব্য কোনো গণমাধ্যম প্রকাশ করতে পারবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃতিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আপনার বক্তব্য দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। আপা, আপাগো আপনার মনে পড়ে কি? একদিন আপনি আদালতের মাধ্যমে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। এখন দেখি আপনার ঠেলে দেয়া বলই ফিরে এসেছে আপনার গায়ে। কি খেলা বুঝুন। মনে মনে বলি- কেন যে ক্ষমতার নেশা আপনার পেয়ে বসেছিল তা জানি না। যদি এ নেশায় না পড়তেন তাহলে দেশ ছেড়ে পালাতেও হতো না। আবার পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতায় আসার সুযোগ থাকতো। 


হাসু আপা, কেউ কেউ বলেন- আপনার এখনো খুশি হওয়ার সময় আসেনি। দেশের দলগুলো যতই মুখোমুখি হউক আপনার এবং আপনার দলের ব্যাপারে এক। তারা কখনো এক্ষেত্রে ছাড় দেবে না। এক হয়ে, হাতে হাত রেখে রাজপথে থাকবে। কারণ গত ষোলটি বছর আপনি রাজসিংহাসনে বসে এদেশের রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের ওপর কতো অত্যাচার করেছেন তা কি এখন শুয়ে শুয়ে মনে করেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে আপনার মতো এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ শাসক আর আসেনি। ভবিষ্যতে আসার সুযোগও নেই। কিন্তু আপনি দেশটাকে নরকে পরিণত করে গিয়েছিলেন। আপনি নিজেকে কি ভাবতেন? বাংলাদেশের জনগণের খেদমতগার হয়ে আপনি তাদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। ক্ষমতায় বসে রঙিন স্বপ্ন দেখেছেন। নোবেল পুরস্কারের জন্য কতো কিছুই না করেছেন? কিন্তু নোবেলের ধারেকাছেও যেতে পারেননি। কি ভয়ঙ্কর কথা- পালানোর আগে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দেশের মালিকদের ওপর গুলি করে মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব কথোপকথন যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুনি গা শিহরে উঠে। ক্ষমতার এত লোভ আপনার? 


সুপ্রিয় হাসু আপা, ক্ষমতার লোভ আপনাকে ডুবিয়েছে। আপনার দলকে ডুবিয়েছে। এখন যারা আপনার কথায় লম্ফজম্ফ করছে ক’দিন পর এরাও থেমে যাবে। হয়তো অন্য কোনো দলের সঙ্গে মিশে যাবে। আর আপনাকে গালমন্দ করবে। বুঝতে পারছেন তো- ক্ষমতায় থাকলে এক আর না থাকলে এক। গত ষোল বছরে আপনি একা দেশটাকে গিলে খেতে চেয়েছেন। অন্য কোনো দলকে পাত্তাই দিলেন না। কাউকে রাস্তায় নামতে পর্যন্ত দিতেন না। কথা বললেই গ্রেপ্তার, মামলা, হামলা আর গুমের রাজ্যে পাঠিয়ে দিতেন। আপনার দলের সাধারণ সম্পাদক প্রায়ই বলতেন আপনি নাকি রাতে ঘুমাতেন না দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে। এ কথা শুনে মানুষ তখন বলতো হ্যাঁ আপনি ঘুমাতেন না ঠিকই; তবে দেশের মানুষকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায় সে চিন্তা করে। অথচ একবারও ভাবলেন না সংসদ হলো দেশের আইন সভা। এখানে সরকারি দল যেমন থাকবে তেমন শক্তিশালী বিরোধী দল থাকাটাও একটা আর্ট। আপনি করলেন কি গৃহপালিত বিরোধী দল বানিয়ে রাখলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটের আগেই সরকার গঠনের মতো আসন পেয়ে গিয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ওই সংসদে তো বিরোধী দল ছিলই না। গৃহপালিত জাতীয় পার্টিকে সরকারের পার্ট করে নিয়েছিলেন। আবার এ দলকেই বলতেন বিরোধী দল। কতো হাস্যকর কাজই না করেছেন সে সময়ে। আরে গণতন্ত্র তো গণতন্ত্রই। আপনি স্লোগান তুলে দিলেন উন্নয়নের গণতন্ত্র। দেশে গণতন্ত্রের দরকার নেই। উন্নয়নের দরকার। অথচ গণতন্ত্রই পারে সত্যিকার অর্থে একটি দেশকে এগিয়ে নিতে। আপনার সময়ে কতো মিথ্যা দেশবাসীকে শুনিয়েছেন একবার চিন্তা করে দেখুন তো। দেশ নাকি মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে। অথচ আপনি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় দেশটাকে ফোকলা করে রেখে গেছেন। চারদিকে ঋণে জর্জরিত করে রেখে গেছেন। আরে বাপরে বাপ ভারতের এক আদানিই যে ডলার পেতো বিদ্যুৎ বাবদ তা শুনে তো দেশবাসী অবাক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আস্তে আস্তে সকল ঋণ পরিশোধ করতে থাকে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাড়তে থাকে। সরকার এখনো আপনার রেখে যাওয়া ফোকলা ভরার কাজে ব্যস্ত। পাশাপাশি আপনার আমলের যত একনায়কতন্ত্রের আইন ছিল তা সমান্তরাল করতে দলগুলোর সঙ্গে দিনের পর দিন আলোচনা করে যাচ্ছে। দেশটাকে সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কাল থেকে যেন ফের শুরু করতে হচ্ছে। পাশাপাশি আপনার উস্কানিমূলক বক্তব্যকে মোকাবিলা করছে। আমার এ লেখায় বলেছিলাম এবার একটু শান্ত হয়ে ক’টা দিন কাটান। শরীরেরও উপকার হবে। মনের দিক দিয়েও আরও ফুরফুরে হবেন। কই কথা শুনলেন? সরকারে থাকাকালে আপনি যেমন কথা বলতেন এখনো তেমনই বলছেন। আপনাকে একবার ভাবতে হবে। আপনি এখন সরকারে নেই। তবে সেদিনের কথা শুনে বুঝা গেল আপনি যে সরকারে নেই এতদিনে মাথায় এসেছে। তাই তো নির্বাচন চাইলেন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে। বললেন, ইউনূস সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। নতুন করে কেয়ারটেকার সরকার করে সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেন। আবার এও বললেন, যদিও আমি এখনো প্রধানমন্ত্রী তারপরও যেহেতু জনগণ নির্বাচন চায় সেহেতু নির্বাচন দেয়া হউক। এখনো এ দেশের প্রধানমন্ত্রী-একথা বলতে কি একবারও মুখে বাঁধলো না? আপনার বিবেক বোধ কি আগের মতোই আছে? এখন তো একটু বদলানো দরকার। কারণ যে ক্ষমতা ছেড়ে আপনাকে পালাতে হয়েছিল সেই ক্ষমতার মসনদে বসতে তো আপনাকে আবার নানা কৌশল করতে হবে। মাঠে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে। নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিতে হবে। তার আগে এত এত মামলার রায় কী হয় তাও তো বিবেচনার বিষয়। গণহত্যার দায়ে আপনার কি শাস্তি হতে পারে একবার ভেবে দেখেছেন? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতিদিন এখন সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে। আবার অভিযোগ জমা পড়ছে। সবই আপনার ও আপনার দলের নেতাকর্মী, আওয়ামী লীগ দলীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এসব শেষ হতে হতে কতো বছর লাগে কে জানে? আপনি যে চট করে বাংলাদেশে এসে পড়বেন এর কোনো আলামত এসবের মাঝে নেই। 


আচ্ছা আপা, একটি কথা জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে হয়। এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন, তা কি কোনো দিন ভেবেছিলেন? কেনই বা ভাববেন? কতো বড় বড় আন্দোলন দমন করে দিয়েছেন গুলি চালিয়ে। আর সেদিনকার  পুলাপাইনের কোটাবিরোধী আন্দোলন সে তো কিছুই ছিল না। কিন্তু কি করে কি হয়ে গেল? এক্ষেত্রে দেশের মানুষ বলছে আপনি বহু আগেই সীমালঙ্ঘন করে ফেলেছেন। আর সীমালঙ্ঘনকারীকে এক সময় তার মূল্য দিতে হয়। যেটা এখন আপনি দিচ্ছেন। এই যে দেখেন যে ডাকসুতে ছাত্রলীগের ভয়ে তটস্থ থাকতো শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা। আজ ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। ছাত্রলীগের কোনো প্যানেল নেই। এটা কি কেউ কখনো ভেবেছিল? আপনি কি কোনো দিন ভেবেছিলেন? তাই বলি ‘ভাবিয়া করিও কাজ। করিয়া ভাবিও না।’ আজ আপা এ পর্যন্তই থাক। আমার এ লেখা আপনার উপলব্ধির জন্য। যদি বুঝেন তাহলে ভালো। অন্যথায় আরও অনেক খেসারত দিতে হবে। 

মতামত'র অন্যান্য খবর