এ ই স ম য়

তাহলে কেমন হতে যাচ্ছে নির্বাচনটি?

হাসান মামুন | মতামত
আগস্ট ৩০, ২০২৫
তাহলে কেমন হতে যাচ্ছে নির্বাচনটি?

ফেব্রুয়ারিতে, রোজার আগ দিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের চিঠি পেয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। কবে নাগাদ তফসিল ঘোষিত হবে- সেটা জানানোর পর নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাজগুলো কতোদিনে সারা হবে, সে বিষয়ক রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়েছে এর মধ্যে। তফসিল ঘোষণার আগে ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণসহ ইসি’র সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ তো রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষও কমবেশি পরিচিত। নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিবিধান সংস্কারের এজেন্ডাও এবার গুরুত্ব পাচ্ছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ রয়েছে। এক্ষেত্রে আছে ইসি’র অভিমতও। নির্বাচনের অংশীজনদের সঙ্গেও ইসি’র সংলাপ হবে। নির্বাচনের দু’মাস আগে তফসিল ঘোষিত হবে, এমন ধারণাই দেয়া হয়েছে। তখন জানা যাবে, ঠিক কবে হতে যাচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন।


রোজা শুরুর বেশ একটু আগেই নির্বাচন হয়ে যাওয়া ভালো। এমনিতেই নির্বাচনের দিকে যেতে দেরি করে ফেলেছে সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অবশ্য জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার আর রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডা ছিল। পাক্কা এক বছর সরকার দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিল এর কতোখানি সম্পন্ন করে তারা নির্বাচনের দিকে যাবেন, সেটা নিয়ে। বিচার ও সংস্কারে গত এক বছরে বড় অগ্রগতি কিন্তু আনতে পারেনি সরকার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদের তালিকা প্রণয়নের কাজও অসম্পূর্ণ রয়েছে। আহতদের চিকিৎসা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ঘোষিত সহায়তা প্রদানেও সাফল্য তেমন নেই। এ নিয়ে মাঝে একাধিকবার অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। খোদ প্রধান উপদেষ্টা একজন সম্পাদককে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নিজেদের অনভিজ্ঞতায় তারা সম্ভবত এগোতে পারছেন না। ব্যর্থতা থাকলে তা স্বীকার করা ভালো। তবে একটি সরকারকে এগিয়ে যেতে হয় সাফল্যের ওপর ভর করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার তার ‘রুটিন’ কাজগুলো সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারছে না।


গণ-অভ্যুত্থানের পর এলোমেলো অবস্থাকে সুশৃঙ্খল করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে গুরুদায়িত্ব নিয়ে সরকার যাত্রা করেছিল, সেটি শেষ হবে একটি সফল নির্বাচন আয়োজনের মধ্যদিয়ে। সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হলেও সফলভাবে নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারলে তাতেও সন্তুষ্ট থাকবে মানুষ। অবশ্যই ভালো হতো বিচার ও সংস্কারে চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি তারা রেখে যেতে পারলে। মাঠে থাকা কোনো রাজনৈতিক দল এ দুই ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বলা যাবে না। তাদের মধ্যে অবশ্য মতপার্থক্য রয়েছে সংস্কারের কিছু সুপারিশ নিয়ে। সংস্কার আলোচনায় যোগদান করে তারা বেশ কিছু ক্ষেত্রে একমতও হয়েছে। সংস্কারের এমন অনেক সুপারিশও রয়েছে, যেগুলোর বিষয়ে আগে থেকে সবাই একমত। সেগুলোর বাস্তবায়নেও সরকার কেন এগোতে পারেনি- তা বোধগম্য নয়। তবে ভালো যে, তারা অবশেষে নির্বাচন আয়োজনের দিকে যেতে পেরেছেন। এর পাশাপাশি বিচার, সংস্কার থেমে থাকারও কারণ নেই। যতটা সম্ভব এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে।


স্থানীয় বা গণপরিষদ নির্বাচন নয়; জাতীয় নির্বাচনই হতে যাচ্ছে দেশে। কোনো কোনো দল আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রয়োজন বলে একটা সময় পর্যন্ত ‘যুক্তি’ দেখাচ্ছিল। আরেক পক্ষ এখনো জোর দিয়ে যাচ্ছে গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে। তারা বলছেন, গণপরিষদ নির্বাচন করে তার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের কাজ সম্পন্ন হলে সেটাই হয়ে যাবে নিয়মিত সংসদ। তারা শুরু থেকে ‘নতুন সংবিধান’ প্রণয়নের পক্ষে সোচ্চার। এ দাবি পূরণ না হলে তারা নির্বাচনে যাবেন না বলেও বক্তব্য রাখছেন। রাজনীতিতে সক্রিয় কোনো পক্ষের নির্বাচনে না যাওয়াটা প্রত্যাশিত নয়। তবে নির্বাচনে না যাওয়ার অধিকারও সবার রয়েছে। কোনো দলকে জোরপূর্বক নির্বাচনে নেয়ার ঘটনা অবশ্য রয়েছে আমাদের নিকট অতীতে। এবার তেমনটি ঘটার দৃশ্যত কোনো কারণ নেই। তবে জাতীয় নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য আসন পেতে সক্ষম কোনো দল নির্বাচনে না গেলে সেটা এর গ্রহণযোগ্যতার দিক দিয়ে ক্ষতিকর হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচন শুধু ‘অংশগ্রহণমূলক’ হলে চলবে না; এটা হতে হবে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’। জনগণের সব পক্ষ যেন পছন্দমতো দলকে নির্বাচনে ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ অংশ নিতে দেখে এবং তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে। ভোট গণনা আর ফল প্রকাশেও কোনো অস্বচ্ছতা যেন না থাকে। এগুলো হলো নির্বাচনের অপরিহার্য শর্ত।


বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব শর্ত পূরণ না করেই তিন-তিনটি নির্বাচন করা হয়েছিল। এতে সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনায় জনমতের প্রতিফলন ঘটানো যায়নি। সরকার দেশ পরিচালনার রাজনৈতিক বৈধতাও অর্জন করতে পারেনি। সরকারকে আইনগত বৈধতা নিয়েও দেশ পরিচালনা করতে হয়। আর নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল সেটি অর্জন করা যেতে পারে। এ মুহূর্তে দেশে যে সরকার রয়েছে, সেটি এসেছে গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে। মাঠে থাকা সব দল ও পক্ষ তাকে অনুমোদন করেছে এবং সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সেজন্যই এটিকে বলা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন একটি সরকার যত কম সময় ক্ষমতায় থাকে, ততই গণতন্ত্রের জন্য ভালো। তাদের দায়িত্ব হলো অপরিহার্য কাজগুলো সম্পন্ন করে যত দ্রুত সম্ভব গণতন্ত্রে উত্তরণের দিকে যাওয়া। ‘অপরিহার্য কাজ’ সম্পন্ন করতে করতে সফলভাবে নির্বাচনের দিকে যেতে না পারলে অবশ্য সবকিছুই গোলমেলে হয়ে যাবে। তাতে দেশ পড়বে গভীরতর সংকটে। সেজন্যই দায়িত্বশীল সবাই নির্বাচনকে সংশয়মুক্ত রাখার ওপর জোর দিচ্ছিলেন। একটু দেরিতে হলেও সরকার সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে বলতে হবে। এখন তার কাজ হবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণে ইসিকে পরিপূর্ণভাবে সহায়তা জোগানো।


অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই বর্তমান ইসি গঠিত হয়েছে। তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তার নেতৃত্বে অবশ্য কোনো নির্বাচন এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। কেউ কেউ বলছিলেন, অন্তত দু’তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজন করে তারা নিজ সক্ষমতার পরীক্ষা দিতে পারতেন। যে কারণেই হোক, সরকার সেদিকে যায়নি। আমরা জানি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে সরকার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্তটাও এসেছে সরকারের দিক থেকে। এর আগেও, এক-এগারোর পর প্রায় দু’বছর লেগেছিল নির্বাচনের দিকে যেতে। তখনো নানান প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা ছিল। হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয় সেভাবে না থাকলেও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন তখনো ছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধেও এক-এগারো পরবর্তী সরকার কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাদেরকেও কিন্তু হাতে নেয়া অনেক কাজ অসম্পূর্ণ রেখে শেষে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যেতে হয়। ক্ষমতার হস্তান্তর হয় শান্তিপূর্ণভাবেই। কিন্তু এর পর আর কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তাতে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয় ক্রমে এবং সরকারও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর পরিণতি তাদের ভোগ করতে হচ্ছে এখন।


সরকার ও ইসিকে নির্বাচন আয়োজনে দৃঢ়চিত্তই দেখা যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বিষয়ে এখনো এক জায়গায় আসতে পারেনি। নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘিরে তাদের প্রতিক্রিয়ায় এটা পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ এখন মাঠছাড়া এবং এর কার্যক্রমও নিষিদ্ধ। এ অবস্থায় মাঠে থাকা প্রধান দল হলো বিএনপি। তারা শুরু থেকে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করবেন বলেই ধারণা। সে কারণেই বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইছিল, এটাও বলা হয়ে থাকে। আর যারা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী নন, তারা নাকি এখনো চাইছেন নির্বাচন পেছাতে। নির্বাচন অনিশ্চিত করে ভিন্ন কোনো লক্ষ্য অর্জনের প্রয়াসও কোনো কোনো মহলের আছে বলে কথা চালু রয়েছে। সেগুলো সত্য না হলেই গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ খুশি হবে। নির্বাচন হলে যারা প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসার সুযোগ পাবে, তাদেরও উচিত হবে না কোনো ওজর আপত্তি জারি রেখে এর পরিবেশ ঘোলাটে করা। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি তথা পিআর অনুযায়ী নির্বাচনটি হবে কিনা, এ নিয়ে একটা বিতর্ক এখনো চলমান। জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করে উচ্চকক্ষে পিআর চালুর বিষয়ে অবশ্য বড় মতপার্থক্য নেই। কিন্তু কোনো পক্ষের সুবিধা হবে বলেই নিম্নকক্ষেও পিআর চালু করতে হবে, এ দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। আর সব দল রাজি না হলে সরকারের পক্ষে তো একক সিদ্ধান্তে কিছু করার সুযোগ নেই। ইউনূস সরকারও কিন্তু শুরু থেকে এমনটাই বলে আসছেন।
সরকারকে তার ঘোষিত এ নীতি অবশ্যই বজায় রাখতে হবে সামনের দিনগুলোতে। সর্বসম্মত ঐকমত্য তার অস্তিত্বেরও ভিত্তি বটে। নির্বাচনটিও হতে হবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ধারায়। সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতিও নির্ধারণ করতে হবে সবার মত নিয়ে। এ মুহূর্তে বিশেষজ্ঞদের মত নিচ্ছে সরকার পক্ষ। বিশেষজ্ঞরাও নিশ্চয়ই জোর দেবেন রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর। সরকার ও ইসি যখন নির্বাচনের দিকে গেছে, তখন ‘ভিন্নমতাবলম্বী’ দলগুলোকেও বুঝতে হবে- এটাই গন্তব্য। এটা জনগণের অভিপ্রায়ও বটে। আগামী নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটার অংশ নেবে। এর চেনা চিত্র তারা বদলে দেবে বলেও মনে করা হচ্ছে। তাদেরকে হতাশ করাটাও হবে খুবই অগ্রহণযোগ্য। গণ-অভ্যুত্থানের পর একটা বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে, দীর্ঘ বিরতির পর হতে যাওয়া নির্বাচনটি কোনো পক্ষের অসহযোগিতায় প্রশ্নবিদ্ধ হলে দেশই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। এর প্রভাব আরও খারাপভাবে পড়বে সংকটগ্রস্ত অর্থনীতিতে। ভূ-রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতিতেও এটা কারও কাম্য হতে পারে না। ্ত
 

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

মতামত'র অন্যান্য খবর