বন্দে মায়া লাগাইছে/পিরিতি শিখাইছে/ দেওয়ানা বানাইছে/কি যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে/বসে ভাবি নিরালায়/ আগোতো জানি না বন্দের পিরিতির জ্বালায়/যেন ইটের ভাটায় কয়লা দিয়া আগুন জ্বালাইছে/দেওয়ানা বানাইছে/ কি যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে...।
সুপ্রিয় হাসু আপা, ক’দিন ধরে গ্রামবাংলার জনপ্রিয় এ লোকগীতি মনকে ব্যাকুল করে তুলেছে। আনমনা করে তুলেছে। বিশেষ করে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের পর। সত্যিই কি যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে...। সত্যিই আপা জানতে ইচ্ছে করে কি এমন যাদু আছে ছাত্রশিবিরের কাছে। যে যাদুতে আপনাকে বশ করে নিয়েছে। ছাত্রলীগের ভোট সব ছাত্রশিবিরের বাক্সে ডুকেছে? আসলে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা ভাব আছে তলে তলে- এটা সবাই জানেন। কিন্তু আপনার ষোল বছরের জমানায় এ জামায়াতের উপর যত খড়্গ চাপিয়েছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করতে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দিয়েছেন। কিন্তু আপনার বিপদে কিন্তু জামায়াত পাশে দাঁড়িয়েছে। সরাসরি নয়, কৌশলে। তাই তো জামায়াতের আমীর প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে মাফ করে দিলাম। এর প্রতিদান কি ডাকসু নির্বাচনে দিলেন? তবে অবশ্যই এটা বলতে হয়- ছাত্রশিবিরের আলাদা একটা ইমেজ আছে। তারা অন্যসব ছাত্র সংগঠনগুলোর মতো নয়। শিবির নেতাদের বিনয়, আচার ব্যবহার, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো এসব ভালো গুণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। আপনি তো ষোলটি বছর দেশকে দু’টি ভাগে ভাগ করে রেখেছিলেন। বক্তৃতা- বিবৃতিতে জামায়াত-শিবিরকে স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার বলে প্রতি মুহূর্তে গালমন্দ করতেন। পুলিশ প্রশাসনকে দিয়ে শিবিরের অস্তিত্ব মাটির সঙ্গে মিইয়ে দিতে কতো কিছুই না করেছেন। শিবির ট্যাগ দিয়ে আপনার পুলিশ বাহিনী যাদের গ্রেপ্তার করেছে এর অর্ধেকই ছিল নিরীহ কিংবা অন্যদলের। এমনকি আওয়ামী ঘরানার শিক্ষার্থীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেক কৌশলের মধ্যে একটা কৌশল ছিল যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের অনেককে একদিন থানা হাজতে রেখে পরদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাৎক্ষণিক জেল দেয়ার নজিরও রয়েছে শয়ে শয়ে। আপনার এই কৌশলের কাছে টিকতে না পেরে শিবির নেয় অন্য কৌশল। ছাত্রলীগের সঙ্গে মিশে যায়। আস্তে আস্তে ছাত্রলীগের পদ-পদবি গ্রহণ করতে থাকে। পাশাপাশি গোপনে তাদের কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। যে সময় ছাত্রলীগ ছাত্রদলকে ঢাবি ক্যাম্পাস ছাড়া করতে ব্যস্ত, ভিপি নুরকে পেটাতে ব্যস্ত- ওই সময়ে ছাত্রলীগে মিশে থাকা শিবিরের লোকজন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে ছিল ব্যস্ত। তাদের এই কৌশলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই শিবির না হউক ব্যক্তিকে মনে জায়গা দিয়ে দিয়েছে। গতবছর পাঁচই আগস্ট আপনি পালিয়ে যাওয়ার পর ছাত্রলীগের পদধারীরাও ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায়। থেকে যায় ছাত্রলীগে মিশে থাকা শিবিরের নেতারা। একটা সময় দেখা যায় তারা নিজেরাই ঘোষণা দিচ্ছে শিবিরের সভাপতি, সম্পাদক কিংবা অন্য কোনো পদধারী নেতা। এই নেতারাই দীর্ঘ চেষ্টার পর দেশকে স্বৈরশাসক মুক্ত করে। জাতিকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেয়। এতকিছু করার পর যখন শুনি ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ সমর্থকদের ভোট শিবিরের বাক্সে গেছে তখন অবাকই লাগে। আবার ভাবি অবাক লাগার কি আছে আওয়ামী লীগ-জামায়াত তো একে অপরের রাজপথের বন্ধু। সেই ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বলুন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে আন্দোলন বলুন- সবই তো হয়েছে হাতে হাতে মিলেমিশে। এখানে বলতে পারেন বিএনপি কি কম গেছে? ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র সরকার গঠনে জামায়াতের ভূমিকা, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর জোট সরকারে শরিক হয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা? এখানে পার্থক্যটা কি জানেন আপা? পার্থক্য হলো-জামায়াতের রাজপথের বন্ধু আওয়ামী লীগ। আর সুবিধা আদায়ের বন্ধু বিএনপি। তাই তো বর্তমান রাজপথে আওয়ামী লীগ বন্ধু হিসেবে জামায়াতকে সাপোর্ট দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেখলাম আপনাকে উদ্ধৃত করে আপনার আমলের মন্ত্রিসভার সদস্য নওফেল লিখেছেন- নেত্রী বলেছে শিবিরকে ভোট দেয়ার জন্য। যদিও আরেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেছেন- আপা ছাত্রদলকে ভোট দিতে বলেছে। ফেসবুকের এসব কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু কিছু মানুষ তো সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই এগুলো বিশ্বাস করে।
প্রিয় আপা, ডাকসু নির্বাচনের পর একটা মহল বলছে, ষোল বছর শিবির মিশেছিল ছাত্রলীগের সঙ্গে। আর এখন শিবির ডাকসুতে ভূমিধস জয় পেয়েছে। এ জয় ছাত্রলীগের। এ জয় আওয়ামী লীগের। কথা তো উঠবেই। কেউ কি কারও মুখ চেপে ধরে রাখতে পারে। যেমন আপনি ক্ষমতায় থাকতে শিবির প্রকাশ্যে পর্যন্ত আসতে পারতো না। আবার কথায় কথায় বলতেন বিএনপি-জামায়াত যেন এ দেশে কখনো ক্ষমতায় আসতে না পারে। এখন কি দেখছেন আপা? বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীরা সব বুঝে। তারা হিসাবনিকাশ করেই এগোয়। তারা এখন আর দেশকে দুই ভাগে ভাগ করতে চায় না। স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার এসব এখন তাদের কাছে বস্তা পচা শব্দ। আর এটি আপনি আপনার ষোল বছরের শাসনকালে করেছেন। এখনকার ছেলেমেয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তাদের বেশির ভাগের পিতারও জন্ম হয়নি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। অথচ আপনি তাদের রাজাকার ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছেন। আগামী রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতি হবে না। সেটার কবর রচনা হয়ে গেছে। আপনার এই সুর ধরে ডাকসুতে ছাত্রদল স্বাধীনতার পক্ষে, দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে স্লোগান তুলেছিল। অপরপক্ষকে পাকিস্তানি বলেও মন্তব্য এসেছে। এসব সাধারণ শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করেনি। বরং প্রত্যাখ্যান করেছে। এবং শিবিরকে লাইন ধরে ভোট দিয়েছে।
প্রিয় আপা, একটি বার্তা ডাকসু নির্বাচন দিয়ে গেছে। আর তা হলো-রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। স্বচ্ছ রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরতে হবে। নতুন প্রজন্ম সেটাই চায়। ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। আর আপনি যদি জামায়াতের মায়ায় পড়ে শিবিরকে ভোট দিতে বলেও থাকেন তাহলে বর্তমান প্রজন্মের মনের কথাই বলেছেন। আর বলে না থাকলেও সেটা ভালো। কারণ শিক্ষার্থীরা তা দেখিয়ে দিয়েছে। তবে জগন্নাথ হলের ভোটের চিত্র দেখে আবার হতাশ হতে হয়। তখন মনে হয় আপনি কি সত্যিই এ ব্যাপারে কথা বলেছেন? জগন্নাথ হলে শিবিরের ভিপি প্রার্থী পেয়েছে মাত্র ১০ ভোট। এসব অঙ্ক মিলালে সব যেন কেমন গোলমাল লাগে। যত গোলমালই লাগুক এটাই সত্যি শিবির এখন ডাকসুর হর্তাকর্তা। চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থীর ভয়েজ।
হাসু আপা, আরও একটি কথা না বললেই নয়, বাংলাদেশের বিগত ৫৪ বছরের রাজনীতিতে কতো ঘটনা ঘটে গেছে। পর্দার ভেতরে, বাইরে কতো যে রং খেলা হয়েছে। সবই তো আপনি জানেন। আগামী দিনগুলোতে কীভাবে যে রাজনীতি পরিচালিত হয় আল্লাহ মালুম। তারপরও আশা জাগানিয়া মন নিয়ে বসে আছি বর্তমান প্রজন্মের দিকে। তারা তাদের মেধা, প্রজ্ঞা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন সামনে। তবে সে মেধা হতে হবে সুচিন্তিত। দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হবে। সে আশা কি পূরণ হবে এ দেশে? এ প্রশ্নও মাঝে মাঝে আসে। ডাকসু আর জাকসু নির্বাচন নিয়ে যে খেলা খালি চোখে দেখা গেছে তাতে কেন জানি আবারো মনে ভয় জেগে উঠছে। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কথা মাথায় কিলবিল করছে। আমরা কি নিজেকে শুধরাতে পারবো? আমাদের কর্মকাণ্ড কি বলে? কেন আমরা নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করি। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেই? এসব প্রশ্ন কুরে কুরে খায়। আপা, আপাগো-জীবনটা বড় বৈচিত্র্যময়। এ জীবনে মায়া-ই সব ওলটপালট করে দেয়। এই মায়া-ই মানুষকে অন্ধ করে দেয়। বোবা করে দেয়। বধির করে দেয়। এই কারণেই বুঝি কবি গানের সুর তুলেছেন- কি যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে...। আবার গাইতে ইচ্ছা হয়-মায়ারে, মায়ারে, মায়ারে, মায়ারে বড় মায়া লাগাইছো/আমায় পাগল বানাইছো/না জানি কি মন্ত্র দিয়া মন কাইড়া নিছো...।
তাই বলি আপা, মায়ায় অন্ধ হওয়া কারও জন্যই মঙ্গল নয়। এতে বিপদ ডেকে আনতে পারে। যেকোনো সময়। যেকোনো মুহূর্তে। আপা, আজ এ পর্যন্তই। আগামীতে সময় নিয়ে কথা হবে। ততদিন ভালো থাকুন।