ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের ফল দেখে বিজয়ীরাও সম্ভবত অবাক হয়েছে। বিশেষ করে কেন্দ্রে যে ফল বেরিয়ে এসেছে, তা দেখে। কেন্দ্রে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রার্থীরা বড় বিজয় পেয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোটের ব্যবধান এত বেশি যে, অন্য সবাই মিলে দাঁড়ালে হয়তো পরিস্থিতি বদলানো যেতো। নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার পর তাই এই প্রশ্ন সামনে এসেছে যে, তবে কি ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ঠেকাতে জোটবদ্ধ হয়ে নামা উচিত ছিল? মাঠে থাকা প্রধান দল বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জন্য এ প্রশ্ন বিব্রতকর। ডাকসুতে তারা একটি পদেও জিততে পারেনি। আর হল পর্যায়ে, কেবল জগন্নাথ হলে মাত্র একটি পদে জিততে সক্ষম হয়েছে। এটা তাদের কাছেও অবিশ্বাস্য ঠেকছে হয়তো। ঘাবড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি বলেও এটাকে বর্ণনা করা যায়।
ছাত্রদল এত খারাপ করেছে যে, এ অবস্থায় আলোচনায় কম আসছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের ফল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের ভেতর থেকে গঠিত দল এনসিপি সমর্থিত ছিল তারা। বাগছাসের অনেকে ওই অভ্যুত্থানে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য আলোচিতও বটে। তবে এর ভেতর দিয়ে সৃষ্ট নতুন প্রেক্ষাপটে তাদের কেউ যে নিজ ক্যাম্পাসে নির্বাচিত হতে পারলেন না, সেটাও মনে রাখবে সবাই। ঐক্য বজায় রেখে নির্বাচনে যেতে এবং সুনির্দিষ্ট বক্তব্য হাজির করতে পারলে হয়তো তারা ভালো করতে পারতেন। তবে সেটাও কতোটা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কেননা মনে করা হচ্ছে, হাসিনা সরকার পতনের পর স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রশিবির ক্রমে এনসিপি আর বাগছাস সমর্থকদের বড় অংশকেও নিজ সমর্থক বানিয়ে ফেলেছে। আর বিগত সরকারের সুদীর্ঘ সময়ে তারা আওয়ামী ছাত্রলীগের সঙ্গে মিশে থেকেও চালিয়ে গেছে কার্যক্রম। জাতীয় পর্যায়ে এটা নিয়ে সমালোচনা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বড় অংশের কাছে তা হয়তো প্রশংসনীয় বলেই বিবেচিত হয়েছে।
হাসিনার শাসনামলে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার কোন দল হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে দাঁড়াতেই দেয়া হয়নি। ছাত্রশিবিরকেও না। ‘শিবির সন্দেহে’ নিপীড়ন চালানো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেরে ফেলা, মেরে না ফেললে নিপীড়নের পর পুলিশের হাতে তুলে দেয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। ক্যাম্পাসে এটা তাদের ‘মজলুমের ভাবমূর্তি’ দিয়েছে। এর পাশাপাশি গুপ্ত অবস্থায় থেকেও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় নতুন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন মোকাবিলায় তাদের মোটেও অসুবিধা হয়নি। সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে গুছিয়ে কাজ করে যাওয়ার ক্ষেত্রে মূল দল জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন শিবিরের সুনামও কম নেই। আর সব ক্ষেতেই তাদের রয়েছে বাঁধা ভোট। তবে প্রাপ্ত ভোট দেখে অনেক ক্ষেত্রেই বোঝা যায়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও তারা সফলভাবে ঢুকে পড়তে পেরেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বীরা হয়তো ধরে নিয়েছিল, এদের মধ্যে ঢুকতে চাইলেও শিবির সফল হবে না। নারী শিক্ষার্থীরা শিবির সমর্থিতদের বিপুলভাবে ভোট দেবে না, এ বিশ্বাসেও চিড় ধরেছে ডাকসু নির্বাচনের পর। ‘পুরনো হিসাব-নিকাশ’ আর কাজ করবে না বলে যারা মনে করতেন, তাদের কথাই সত্য হয়েছে এ ক্ষেত্রে।
নব্বইয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার পর ২০১৯ সালেই কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তাতেও ছিল আওয়ামী ছাত্রলীগকে জেতানোর আয়োজন। এর মাঝ দিয়ে ভিপিসহ দু’-একটি পদে ঘটে যায় ‘অঘটন’। তারপর স্বভাবতই তারা আর নির্বাচনের পথে হাঁটেনি। স্বাধীনতা অর্জনের পর, ১৯৭৩ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হলেও এর ফল বানচাল করতে মুজিববাদী ছাত্রলীগ কী করেছিল, সেটা সবারই জানা। তারপর তারাও আর নির্বাচন দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে ওইসব ঘটনা নিয়ে সম্ভবত কমই আলোচনা করে একালের শিক্ষার্থীরা। তারা বেশি মনে রেখেছে নিজেদের তাজা অভিজ্ঞতা, যেটা নিকট অতীতেই হয়েছে হাসিনা সরকারের আমলে। তারা সম্ভবত এটাও বেশি করে বিচার করে দেখেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে কারা কী করেছে। তবে কি তাদের সিংহভাগ এটাই মনে করেছে যে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সবচেয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে হাসিনা সরকার পতনের পর?
ছাত্রদল ছাড়া আর কোনো সংগঠন স্বনামে প্যানেল ঘোষণা না করলেও সচেতন শিক্ষার্থীরা জানতো, কারা কোন রাজনৈতিক ধারার অনুসারী। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ভুলেভালে ভোট দিয়েছে বলার সুযোগ নেই। ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ ভালো ছিল নানারকম শঙ্কার মধ্যেও। কিছু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির মধ্যেও ভোট গ্রহণ ও গণনা ভালোভাবে হয়েছে। শিক্ষকদের বড় অংশ বিএনপি সমর্থক বলে তাদের অগোচরে বড় কোনো জালিয়াতি হয়েছে বলে মনে করারও কারণ নেই। ডাকসুতে পরাস্ত হওয়ার পর মূল দল বিএনপি’র কেউ কেউ অবশ্য বলার চেষ্টা করেছেন, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ভোট পেয়েছে শিবির সমর্থিতরা। তবে জগন্নাথ হলের ভোটের প্যাটার্ন বলে দেয়, তেমন কিছু ঘটেনি। হলগুলোতে ছাত্রদল পূর্ণ প্যানেল দিতেও ব্যর্থ হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। হলে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কী থাকবে না, সে বিবাদেও তারা মনে হয় হারিয়েছে শিক্ষার্থীদের সমর্থন। কেন্দ্রেও নিজেদের প্রার্থী স্থির করে প্রচারে নামতে দেরি করে ফেলেছে। বড় দলের সমস্যাও বড়! তাদের দৃষ্টি সম্ভবত নিবদ্ধ ছিল জাতীয় নির্বাচনে, যেখানে তাদের জয় অবধারিত বলেই মনে করছেন অনেকে। ডাকসু নির্বাচন সে জায়গাটায় তাদের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে হয়তো। তবে সে কারণে ফল এতটা খারাপ হবে, সেটা বোধহয় ভাবতে পারেনি তারা। এখন স্বভাবতই তাদের এ অবস্থাটার নিবিড় মূল্যায়ন করতে হবে।
ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে কতোটা পড়বে, সে আলোচনাও স্বভাবতই শুরু হয়ে গেছে। এ আলোচনাও হচ্ছে, গত এক বছরের জাতীয় রাজনীতির প্রভাব কতোটা পড়েছে ডাকসু নির্বাচনে। বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদল খারাপ করায় এটি বলা হচ্ছে যে, দেশ জুড়ে এ দলের নেতাকর্মীদের একাংশ চাঁদাবাজিসহ অনাচারে লিপ্ত হওয়ায় তাদের সবারই ভাবমূর্তি খারাপ হয়েছে। ক্যাম্পাসে ছাত্রদল আলাদা করে নেতিবাচক ভূমিকায় ছিল, এটা কিন্তু বলা যাবে না। নির্বাচনী প্রচারণায় তারা যে সরকারি ছাত্র সংগঠনের মতো আচরণ করেছে, তাও নয়। তবে এটি বলা হচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া মডেলে তথা বয়ান দিয়ে ছাত্রশিবির সমর্থিতদের মোকাবিলা করতে চেয়েছে। আর ধরে নিয়ে বসে ছিল, এতে কাজ হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান যে এ বয়ানবাজিকে অনেকটা অকার্যকর করে দিয়ে গেছে, সেটা তাদের হয়তো মনে ছিল না। জাতীয় পর্যায়েও জামায়াতে ইসলামীকে ঠেকাতে বিএনপি’র একাংশ অব্যাহতভাবে একাত্তরে তাদের ভূমিকাকে সামনে আনছে। মাঝে সুদীর্ঘ সময়ে দলটির ‘অর্জন’ যে কম নয়, সেটা সম্ভবত বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। অব্যাহতভাবে তাদের নির্যাতিত হওয়ার ভাবমূর্তি জনগণের একাংশে যে সহানুভূতির জন্ম দিয়েছে, সেটাও সম্ভবত খেয়াল করা হচ্ছিল না। হাসিনা সরকার গণ-অভ্যুত্থানের শেষদিকে যাদের নিষিদ্ধ করেছিল, তাদের নাম জামায়াত-শিবির। আর সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের সুদীর্ঘকাল কাজ করতে দেয়া হয়নি। শিবিরকে কার্যত নিষিদ্ধ করে রাখার এ প্রক্রিয়ায় ছাত্রদলও শামিল ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসব দিকও নিশ্চয় ব্যাপকভাবে প্রচার করে ফল পেয়েছে ছাত্রশিবির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের বিপুল বিজয়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলেই বর্ণনা করা হচ্ছে। একথাও ঠিক, সনাতনী রূপে আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রশিবির এটি পায়নি। তাদেরকে কিছুটা হলেও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে আসতে হয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভের পরও তারা গেছে একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত সৌধে। সেখানে মোনাজাত করেছে তাদের জন্য, যাদের হত্যাকাণ্ডে জামায়াতের সাবেক নেতাদের একাংশের ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি, তাই ওই প্রশ্ন এড়িয়ে তারা পথ চলতে পারবে বলেও মনে হয় না। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আগামী বছরেই পরবর্তী ডাকসু নির্বাচন হবে। ততদিনে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে যেতে পারে। পরাজয়ের কারণগুলো নির্ণয় করে ছাত্রদলও নিশ্চয় সংগঠন গোছাবে। ডাকসু নির্বাচনে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ছাত্রশিবির, তার বাস্তবায়নে নতুন নেতৃত্বের ভূমিকাও দেখতে চাইবে শিক্ষার্থীরা। অনেকে বলছেন, ক্যাম্পাসে ও হলে ছাত্রলীগের মতো আচরণ তারা আর দেখতে চায় না কোনো সংগঠনের কাছ থেকে। বিজয়ী ছাত্রশিবিরকে সেদিকেও রাখতে হবে সতর্ক দৃষ্টি। হল সংসদেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিবির সমর্থিতরা ভালো করেছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে বাগছাস সমর্থিতরা। তাদের সামনেও সুযোগ রয়েছে ব্যর্থতার কারণগুলো খতিয়ে দেখে এগিয়ে যাওয়ার। এনসিপি’র মতো বাগছাস নেতাদের একাংশও গত এক বছরে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে বিতর্কিত হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে পুরনো মডেলে রাজনীতি করে জায়গা করে নেয়ার চেষ্টার অভিযোগ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জামায়াত-শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা কেউ অস্বীকার করে না। এরপর গত এক বছরে তাদের ভূমিকাই কি অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার সঙ্গে সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল? এ প্রশ্ন এড়ানো যাচ্ছে না ডাকসু নির্বাচনের ‘অবিশ্বাস্য ফল’ দেখে। এটা জামায়াত-শিবিরকে উজ্জীবিত করবে। এও ঠিক, প্রতিপক্ষকে এটা সতর্ক করবে পরিবর্তিত বাস্তবতায় তাদের চর্চিত রাজনীতি ও এর কৌশল বিষয়ে। রাজনীতিতে কৌশল থাকাটাই স্বাভাবিক। কৌশল করেও যদি কোনো পক্ষ এগিয়ে যায়, সেটা অভিযোগের বিষয় হতে পারে না। দেখতে হবে, রাজনীতির সমান সুযোগ বহাল আছে কিনা। শিক্ষার্থী ও জনগণের বিচার করার পরিপূর্ণ সুযোগও বহাল থাকতে হবে। তারা যে সবসময় একই রায় দেবে, সেটা নাও হতে পারে। কোনো রায়ই চূড়ান্ত নয়, এটাও মানতে হবে।
এ নিবন্ধ লেখার সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে যাওয়া নির্বাচন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। ছাত্রদলসহ কয়েকটি প্যানেল নির্বাচন বর্জন করেছে শেষ মুহূর্তে। অশান্তিপূর্ণ না হলেও এ নির্বাচনে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে বেশি। আরও একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা জানি না, এর পরে কী হবে। তবে জয়-পরাজয় যেটাই হোক, নির্বাচন ব্যবস্থা জোরদার করার পক্ষে থাকতে হবে সব রাজনৈতিক দলকে। এটা এড়িয়ে গণতন্ত্র জোরদার করার কোনো সুযোগ তো নেই।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট