ভারতের নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর অন্যতম নেপাল। সমপ্রতি সেই নেপালের পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনী হাল ধরেছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের চিত্রনাট্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছে নেপালের জেন-জি’র নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের। বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছে সংসদ ভবন থেকে শুরু করে সিংহদরবার সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদের আবাসন এলাকা এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা। বিক্ষোভকারীরা নেতা-মন্ত্রীদের বেদম প্রহার করেছেন। ঠিক বাংলাদেশের মতোই সেনাপ্রধানের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ক্ষমতা ছেড়ে ওলি হাসিনার মতো দেশত্যাগী হন নি। তিনি সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে সুরক্ষিত রয়েছেন।
নেপালের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘জেন-জি’ আন্দোলন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য এক সতর্কবার্তা বলে মনে করা হচ্ছে। নেপালের কৌশলগত অবস্থানের কারণে দেশটিতে যেকোনো অস্থিরতা ভারতের জন্যও উদ্বেগের। প্রবীণ কূটনীতিক ভেনু রাজামনিও মনে করেন, নেপালে যা ঘটছে তা শুধু মর্মাহত হওয়ার বিষয় নয়, উদ্বেগজনকও।
২০২৫ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ওলি সরকার ২৬টি জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরম বন্ধ করে দেন। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা সেটিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে অভিহিত করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদিও আন্দোলনের তাৎক্ষণিক সূত্রপাত এই ডিজিটাল নিষেধাজ্ঞা থেকে হলেও এর শিকড় প্রোথিত ছিল দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি এবং অকার্যকর শাসনব্যবস্থায়।
নেপালের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। ভারতের পাঁচটি রাজ্য উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, সিকিম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নেপালের প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার (৪৬৬ মাইল) দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্তের প্রায় পুরোটাই খোলা। দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে কোনো কাঁটাতার বা বাধা-নিষেধের কড়াকড়ি নেই। দুই দেশের মানুষ পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়াই একে অন্য দেশে যাতায়াত করতে পারেন। সীমান্ত এলাকায় নেপালি ও ভারতীয়রা আত্মীয়তার বন্ধনেও আবদ্ধ। নেপালের সঙ্গে ভারতের আর্থিক ও ব্যবসায়ীক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
ভারত ও নেপালের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী নেপালের নাগরিকরা ভারতে বিনা বাধায় কাজ করতে এবং থাকতে পারেন। প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি বর্তমানে ভারতে কাজ করছেন এবং বসবাস করছেন। ভারতের সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টে প্রায় ৩৫ হাজার নেপালের নাগরিক রয়েছেন। এমন সম্পর্ক সত্ত্বেও নেপালের সঙ্গে চীন ঘনিষ্ঠ ওলির আমলের সামপ্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ একরকম ছিল না বললেই চলে।
বরং ভূখণ্ড নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র হয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের প্রকাশিত একটি মানচিত্র নিয়ে নেপাল পাল্টা মানচিত্র প্রকাশ করেছিল। ওই মানচিত্রে চীন সীমান্তের কাছে পশ্চিমাঞ্চলের এমন কিছু এলাকা ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, যেগুলো নেপাল সরকার নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। সমপ্রতি চীনের সঙ্গে ভারতের আলোচনায় লিপুলেখ গিরিপথকে বাণিজ্যপথ হিসেবে ব্যবহার করা নিয়ে নেপাল আপত্তি উত্থাপন করে।
ভারত অবশ্য সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতির উপর নজর রেখে চলেছে। আর তাই জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তা বিষয়ক কেবিনেট কমিটির বৈঠকে বসে প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। এর পরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেপালের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করে বার্তা দিয়েছেন। নেপালের সব ‘ভাই-বোনের প্রতি’ আবেদন করেছেন, তারা যেন শান্তির সহায়ক হন।
সাময়িকভাবে ভারত নেপালের ঘটনাবলী থেকে রাজনৈতিকভাবে দূরে থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তাই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ওলি ভারতের বিরুদ্ধে অশান্তির সব দায় চাপিয়ে দিলেও ভারত কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতকে আপাতত সাবধানী হয়ে পা ফেলতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা বুমেরাং হতে পারে। কেননা, সরকার পরিচালনা করা প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রত্যেকটির প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে জেন-জি’র।
সাবেক কূটনীতিক রাজামনি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমি মনে করি আমাদের বিষয়গুলো স্থির করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। (কিন্তু) আমাদের এটিকে খুব সাবধানে দেখা উচিত, কারণ এটি আমাদের জন্য এবং নেপালে আমাদের স্বার্থের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। নেপালের কৌশলগত অবস্থানের কারণে ভারত ও চীন-উভয়ই দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে। ফলে এশিয়ার দুই শক্তিকে বারবার নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগের মুখে পড়তে হয়েছে।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো গত চার-পাঁচ বছরে নজিরবিহীন রাজনৈতিক অস্থিরতার সাক্ষী হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা, তারপর বাংলাদেশ এবং এখন নেপাল, দেশব্যাপী আন্দোলন ক্ষমতায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। নেপালে এমন এক সময়ে সংকট তীব্রতর হয়েছে, যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তলানিতে, বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপড়েন চলছে এবং মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে। অন্যান্য প্রতিবেশীরাও অস্থিতিশীলতার সঙ্গে লড়াই করছে। নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতার ধারাবাহিক ঘটনা স্পষ্টতই স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়।
২০২১ সালে আফগানিস্তান নেপালের বর্তমান অস্থিরতার অনুরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল যখন তালেবান কাবুলে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। মার্কিন সমর্থিত শাসনের পতন ঘটে এবং তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালের ১৫ই আগস্ট রাষ্ট্রপতি আশরাফ ঘানি পদত্যাগ করেন এবং তালেবানরা রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ দখল করে নেয়। তালেবান শাসন সেখানে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও আফগানিস্তান এখনো অর্থনৈতিক সংকটে আটকে রয়েছে। ভারত অবশ্য সমপ্রতি তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তৎপরতা শুরু করেছে।
আফগানিস্তানের অশান্তির এক বছর পরে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়। গোটা দেশ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা সরকারি সম্পত্তি পুড়িয়ে দেয় এবং রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ ও সংসদে হামলা চালায়। রাষ্ট্রপতি গোটাবাইয়া রাজাপাকসে রাতে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
রাজাপাকসে সরকারের আমলে বিদেশি ঋণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গিয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারি এবং পর্যটন খাতে মন্দার কারণে রুটির মতো মৌলিক পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল। জ্বালানি ও ওষুধের ঘাটতির কারণে ব্যাপক কালোবাজারি হয়েছিল।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে একটি ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে, যাকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলা হয়। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিতর্কিত সংরক্ষণ নীতির কারণে ক্ষোভের শিকার হয়েছিল। জুলাই-আগস্টে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে যখন নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়। ৩০০ জনেরও বেশি নিহত হয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বঙ্গভবন দখল করে নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানের চাপের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক এবং হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন গত এক বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। ভারত তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের ঘোষিত নির্বাচনের দিকে।
পাকিস্তানও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শিকার হয়েছে। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে অপসারিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সমর্থকদের প্রতিবাদের পাশাপাশি তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর মতো সংগঠনগুলো উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান এবং বেলুচিস্তানে প্রায়ই ড্রোন বোমা ব্যবহার করে হামলা চালাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)’র মতো সংগঠন, যারা একতরফাভাবে বেলুচিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে, তারাও শেহবাজ প্রশাসনকে হুমকি দিয়ে চলেছে। এই আবহে ভারতের আক্রমণে পাকিস্তান পর্যুদস্ত হয়েছে। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানাবিধ বিধিনিষেধও আরোপ করেছে।
ভারতের আরেক প্রতিবেশী মালদ্বীপে মোহাম্মদ মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর ভারতের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। চীন ঘনিষ্ঠ এই নেতা ভারতের সামরিক উপস্থিতিকেও বিদায় জানায়। অবশ্য ভারত অপেক্ষার নীতি নিয়ে চলার পর মইজ্জু ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে চাইছেন।
এদিকে, মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সামরিক শাসন চালু করার পর থেকে দেশের মানুষ প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ। সামরিক জান্তা অস্ত্রের মুখে বিক্ষোভ দমাতে গিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। মিয়ানমারের একটি বড় অংশের দখল নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে শরণার্থী সংকট দেখা দিয়েছে। ৬৫ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু, প্রধানত চিন জাতিগোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করেছে। তবে মিয়ানমার বাংলাদেশের মতোই নির্বাচনের দিকে পা বাড়িয়েছে।
অস্থিতিশীল সবক’টি প্রতিবেশী দেশে (পাকিস্তান ছাড়া) ভারতের বড় মাপের আর্থিক বিনিয়োগ রয়েছে। আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থও রয়েছে। ফলে ভারতকে নানা দিক দিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আগ বাড়িয়ে নাক গলানোর নীতি থেকে ভারতকে সরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। সামগ্রিকভাবে অস্থিতিশীল প্রতিবেশীর কারণে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিও এখনো ঝুঁকির মধ্যে। ভারতের লুক ইস্ট নীতিও এখন সংকটে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) বর্তমানে নিষ্ক্রিয় থাকায় পারস্পরিক আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোতে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অস্থিরতার মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেয়া ভারতের পক্ষে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।