যে দেশে মানুষ যুক্তির বদলে সব সময় আবেগকে প্রাধান্য দেয়, কারও মূল্যায়ন করতে গিয়ে তথ্য-প্রমাণের চেয়ে নিজের ইচ্ছেপূরণের গল্প বলতে পছন্দ করে, সে দেশে সদ্যপ্রয়াত একজন মনীষী লেখকের নির্মোহ মূল্যায়ন অসম্ভব। সেটি যেমন বদরুদ্দীন উমরের বেলায় সত্য, তেমনি যতীন সরকারের জন্যও প্রযোজ্য। অথচ এই দুজন মনীষীর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্বিমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করলাম। একপক্ষ নিন্দার ঝড় বইয়ে দিচ্ছে, অন্যপক্ষ স্তুতির জোয়ারে ভাসছে। আজ বদরুদ্দীন উমরকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু অবলোকন পাঠকের কাছে তুলে ধরবো। যতীন সরকার সম্পর্কে ভবিষ্যতে লেখার আশা আছে।
বদরুদ্দীন উমরের জীবন ছিল বহুমাত্রিক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করেছেন, লেখক শিবির করেছেন, নিজে একাধিক রাজনৈতিক মঞ্চ করেছেন, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ে সর্বদা সোচ্চার থেকেছেন। লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ে। উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ যেমন তার গবেষণার বিষয় ছিল, তেমনি বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসও উঠে এসেছে তার লেখায়। উমরের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি সেরা গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ছাত্রজীবনে বদরুদ্দীন উমর তমুদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার বাবা আবুল হাশিম ছিলেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। বলতে গেলে আবুল হাশিমই সংগঠনটিকে নবাব-অভিজাতদের কাছ থেকে নিয়ে এসে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছেন। পরবর্তীকালে এদেশে যারা মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এমনকি বাম রাজনীতিতে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন আবুল হাশিমের শিষ্য।
বদরুদ্দীন উমরের চিন্তাভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে অক্সফোর্ডে পড়ার সময়, তিনি সে সময় মার্ক্সীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালেই উমর খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান ১৯৫৭ সালে। সেখানে তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে তার সক্রিয় সদস্য ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দিন আহমদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম, মুশাররফ হোসেন প্রমুখকে নিয়ে যে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়, তার ‘অপরিহার্য’ সদস্য ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি সে সময়ে মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সম্পাদিত পূর্বমেঘ-এ বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে যেই প্রবন্ধগুচ্ছ লিখেছিলেন, তারই বর্ধিত ও সমপ্রসারিত রূপ ছিল-সামপ্রদায়িকতা, সংস্কৃতির সংকট ও সাংস্কৃতিক সামপ্রদায়িকতা। বই তিনটি সে সময়ে বাঙালির জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে আলোড়ন তোলে; যদিও উমর ছিলেন বামচিন্তার অধিকারী।
বাংলাদেশ আমলে অনুকূল পরিবেশে সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু পাকিস্তান আমলে বৈরী পরিবেশে এ কাজটি করেছেন আবদুল হক, আবুল ফজল ও বদরুদ্দীন উমরের মতো হাতেগোনা দু’একজন বুদ্ধিজীবী।
এই লেখায় উমরের সার্বিক কাজের মূল্যায়ন না করে ব্যক্তিগত আলাপে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে কী বলেছেন, তার ওপর কিছুটা আলোকপাত করবো।
২০২১ সালে উমরের নব্বইতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের সঙ্গে যুক্ত বন্ধু ওমর তারেক চৌধুরী বললেন, তাকে নিয়ে প্রথম আলোতে কিছু করার অনুরোধ জানান। বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি লেখার চেয়ে তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেয়ার পরামর্শ দেন। বলেন, একটি লেখায় আর উমর ভাইকে মূল্যায়ন করা যাবে না। তার চেয়ে সাক্ষাৎকারে তার জীবন ও কর্ম উঠে আসবে। নতুন প্রজন্মের পাঠকরা তার সম্পর্কে জানতে পারবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সহকর্মী মনোজ দে-কে নিয়ে ডিসেম্বরের এক সকালে রূপনগরে তার বাসায় গেলাম। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে বলেছেন। সমাজ ও শিক্ষার নানা অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলেছেন। সবচেয়ে কঠিন সমালোচনাটি করেছেন বামপন্থিদের।
আলাপ প্রসঙ্গে উমর খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমার বেঁচে থাকা মানুষকে অনুপ্রাণিত করলে বাস্তবে তো দেখতাম। আমি বলবো, আমি একধরনের উপেক্ষিত। আমি যে এত কাজ করেছি, আমাকে নিয়ে কোনো জায়গায় কোনো লেখা পাবেন না। এখানে এত লোকের ওপর লেখা হয়, কিন্তু আমার লেখা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। এমনকি আমার ভাষা আন্দোলনের বইয়ের ওপরও কোনো আলোচনা নেই। কলকাতায় আমার বই ও লেখার ওপরে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক কৃত্যবিদ মানুষ আমার ওপরে লিখেছেন। সেটা বাংলাদেশে চিন্তাও করা যায় না। কাজী আবদুল ওদুদ, মৈত্রেয়ী দেবী, নারায়ণ চৌধুরী, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বিনয় ঘোষ, অশোক মিত্র-এরা আমার কাজ নিয়ে লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। এরা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে উঁচু স্তরের মানুষ। দলনির্বিশেষে তারা আমার ওপরে লিখেছেন। কিন্তু এখানে দলনির্বিশেষ উপেক্ষা করা হয়েছে।’
দেশ বিভাগের আগে ও পরের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে উমর বলেন, বর্ধমানে আমাদের একটা ভালো অবস্থান ছিল। ’৪৭-এর পর খুব একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে-এ রকম কিছু বোধ করিনি। তারপর হঠাৎ করে ১৯৫০ সালে একটা দাঙ্গা হলো। তবে বর্ধমানেও একটা-দুইটা ঘটনা ঘটেছিল। কিছু লোক আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছিল। এ ঘটনায় আব্বা (আবুল হাশিম) খুব ভেঙে পড়লেন। তারপর উনি আর ওখানে থাকতে চাইলেন না। কিন্তু এমনিতে আমাদের কোনো অসুবিধা ছিল না।
বাংলাদেশে সামপ্রদায়িকতা প্রসঙ্গে তার পর্যবেক্ষণ ছিল, এখানে সামপ্রদায়িকতার ভিত্তিভূমির যে শর্ত, সেটা সাতচল্লিশে শেষ হয়ে গেছে। কারণ, এর সামাজিক ভিত্তি নেই। সামপ্রদায়িকতার ভিত্তি ছিল হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব। হিন্দুরা শক্তিশালী ছিল, অর্থশালী ছিল, বিদ্যাশালী ছিল। মুসলমানদের অবস্থান তার চেয়ে নাজুক ছিল। সাতচল্লিশ সালের পর মুসলমানরা প্রাধান্যে চলে আসায় এই দ্বন্দ্বটা চলে গেল। এরপর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতীয় উন্মেষের চিন্তা সামনে চলে এলো। ভিত্তিভূমিটা পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন নতুন দ্বন্দ্ব বাঙালি-অবাঙালি, পূর্ব পাকিস্তান-পশ্চিম পাকিস্তান। ’৭১-এর পর সামপ্রদায়িকতার ভিত্তিভূমি ছিল না। এখানে এখন যেটা আছে, সেটা হলো রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। এখন যে সামপ্রদায়িকতার কথা বলা হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় হামলা হচ্ছে, সেগুলো করছে কারা? শাসকশ্রেণির লোকদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যের সম্পত্তি দখল করছে। মুসলমানদের সম্পত্তিও দখল করছে তারা।
পাকিস্তান আমলে বামপন্থিদের ব্যর্থতা সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হলো: এখানে দু’টি বিষয় ছিল। শ্রেণি-সংগ্রাম ও জাতীয় দ্বন্দ্ব। কমিউনিস্টরা না বুঝেছিল শ্রেণি-সংগ্রাম, না বুঝেছিল জাতীয় সংগ্রাম। শ্রেণি-সংগ্রামের আওয়াজ তুলেছিল তারা, কিন্তু শ্রমিকের মধ্যে, কৃষকের মধ্যে কতোখানি কাজ তাদের ছিল? সাতচল্লিশের পর তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেল। তারা জনগণের মধ্যে কতোটা যেতে পেরেছিল? তারা যেটুকু সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল, সেটা আদিবাসীদের এলাকায়। সাধারণ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তাদের তেমন আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনের পরে, এখানে জাতীয় দ্বন্দ্ব যেটা তৈরি হচ্ছিল, সেটা আসলে শ্রেণি-দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। এ দু’টির মধ্যে একটা মিল আছে। কিন্তু মিলের জায়গাটা কমিউনিস্টরা ধরতে পারেননি। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব ছিল জাতীয় সংগ্রামের বিকাশ তথা পাকিস্তানিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যে প্রধান বিষয়, সেটা ভালোভাবে ধরতে পেরেছিলেন। মাওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানদের কাণ্ডজ্ঞান কমিউনিস্ট নেতাদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এই কাণ্ডজ্ঞানের মধ্যদিয়ে তারা বুঝেছিলেন, এখন জাতীয় সংগ্রামের বিকাশ ঘটানো দরকার। সক্রিয় রাজনীতিতে আসার পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উমর বলেন, আমি চাকরি ছেড়ে দেবো, রাজনীতি করবো, সেটা অনেক আগে থেকেই চিন্তা করে রেখেছিলাম। পরে মোনায়েম খানের কর্মকাণ্ডে আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। আমাকে তারা তাড়াতে কিংবা বরখাস্ত করতে পারতো না, কিন্তু নানা রকম হয়রানি করছিল। চাকরি ছেড়ে গেলাম রাজনীতি করতে। মাওলানা ভাসানী বললেন, তুমি কৃষক সভার সম্পাদক হও। আমি বললাম, কী বলছেন আপনি? আমি বাংলাদেশের গ্রাম সম্পর্কে কিছুই জানি না। কৃষক সম্পর্কে কিছুই জানি না। কৃষক সভার সম্পাদক কী করে হবো? তারপর উনি বললেন, তুমি ন্যাপের সম্পাদক হও। আমি তখন বললাম, আমি ন্যাপ করবো না। আমি চাকরি ছেড়ে ন্যাপ করতে আসিনি। আমি কমিউনিস্ট পার্টি করতে এসেছি। অন্য কোনো পার্টি করবো না। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নানা ভাগে বিভক্ত। আমি সুখেন্দু দস্তিদার-আবদুল হকদের দলে যোগ দিলাম। অন্য যে পার্টিগুলো ছিল, সেগুলোর কোনোটাকেই কমিউনিস্ট পার্টি বলা যাবে না। নেতাদের কারও লেখাপড়া ছিল না। কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে আবদুল হকই মার্ক্সের ‘দাস ক্যাপিটাল’ পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি ‘পাঠ’ করেছেন, গভীরে যাননি। গণশক্তি পত্রিকায় তিনি যেসব লেখা লিখেছেন, সেগুলোও ছিল সুপারফিসিয়াল। শরতের মেঘের মতো দেখতে সুন্দর, ভেতরে প্রাণ নেই, জীবন নেই। সে কারণে একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে আমি পার্টি ছেড়ে দিলাম। এটা যেমন ঠিক, আবার এটাও ঠিক, এখন যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, আবার যদি সুযোগ হয় তুমি কোন পার্টিতে যোগ দেবে? আমি বলবো, সুখেন্দু দস্তিদারের ওই পার্টিতেই যোগ দেবো।
আমাদের প্রশ্ন ছিল: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট আন্দোলন তো সংকটে পড়লো?
জবাবে উমর বললেন, এই সংকট তো তারা নিজেরাই তৈরি করেছেন। তারা আওয়ামী লীগ ও ইয়াহিয়া খানকে একই পাল্লায় মাপলেন। এটি কখনো হয় নাকি? যেখানে দেশের মানুষ লড়াই করছে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে, সেখানে তারা বলে দিলেন ‘দুই কুকুরের লড়াই।’ এর চেয়ে সর্বনাশা কিছু হতে পারে না। তাদের উচিত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করা। এপ্রিলের শুরুতে একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গে আমিও ছিলাম। সেখানে মাওলানা ভাসানীর একটি চিঠিও দেখানো হলো। ঠিক হলো কমিউনিস্টরাও একসঙ্গে লড়াই করবে। কিন্তু এপ্রিলের ১৩ বা ১৪ তারিখে আমি যশোরে ছিলাম। চৌ এন লাইয়ের বিবৃতি দেখানো হলো, যেখানে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলেছেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে সৈয়দ জাফর নামের এক কর্মী ছিলেন, তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এরপর তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ও শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন নিলেন। যেখানে জাতীয় সংগ্রাম চলছে, সেখানে তারা শ্রেণিশত্রু খতম করতে গেলেন। আপনি যখন একটি মানুষকে হত্যা করবেন, তখন তার আত্মীয়স্বজন, পরিবার, প্রতিবেশী- সবাই বিরুদ্ধে চলে যাবে। সেটাই হয়েছে। ফলে জনগণ তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলো এবং ’৭১-এর আগস্টে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। নিজের বোকামি ও মূর্খতার কারণেই তাদের এই অবস্থা হয়েছে।
এই ক্ষণায়ু প্রতিষ্ঠান ও পত্রিকার দেশে উমর ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংস্কৃতি নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেছেন। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা-এর কোনটিকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। উমরের জবাব ছিল, একসময় আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে সংগঠিত করেছি। কিন্তু এই ৯০ বছর বয়সে তো সেটি সম্ভব নয়। এখন তো ঘরের বাইরে যেতে পারি না। এখন লেখালেখিও কম করি। সংস্কৃতি ও কলকাতার দু’-একটি পত্রিকায় লিখি। তবে পড়ি বেশি। চারতলায় আমার পাঠাগারটিতে পড়ার মতো অনেক বই আছে। আবার অনলাইনে কিনেও অনেক বই সংগ্রহ করি। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মননশীলতার অভাব প্রসঙ্গে উমরের সোজা সাফটা কথা হলো: শরীরে ইনজেকশন দিয়ে তো মননশীলতা তৈরি করা যায় না। রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করেও এটি পাওয়া যাবে না। এর জন্য চর্চা দরকার। আজ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জ্ঞানের চর্চা বলে কিছু নেই। কিন্তু ভারতে মোদি সরকার যতই দুর্বৃত্তায়ন চালাক না কেন, সেখানে প্রগতিশীলেরা, কমিউনিস্টরা ইতিহাস চর্চা করছেন। রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, অমিয় কুমার বাগচীর মতো অনেক ইতিহাসবিদ আছেন। আর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকান, কোনো ইতিহাসবিদ নেই। এমনকি সৃজনশীল সাহিত্যেও তো আখতারুজ্জামান, হাসান আজিজুল হকের পর উল্লেখ করার মতো কাউকে দেখছি না। এই যে সাতচল্লিশ সাল থেকে এত সংগ্রাম করে এখন যে অবস্থা দাঁড়ালো, তা খুবই হতাশাজনক। অর্থনীতির দিকে তাকালেও দেখবো একদিকে মেট্রোরেল, টানেল, পাতালরেল হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই, সেতু নেই। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। ঢাকা থেকে দুই ঘণ্টায় চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য বুলেট ট্রেনের পরিকল্পনা আছে। কিন্তু আমাদের দেশ তো জাপান নয়। এই অর্থ স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা যেত। স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবস্থা খুবই শোচনীয়। উন্নয়নের সুফল তো ১ বা ২ শতাংশ মানুষের কাছে যাচ্ছে। জিনিসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে না ঠিক, তারা অপুষ্টিতে ভুগছে। বৈষম্য সর্বত্র।
উমর মনে করেন, চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে, এর ভবিষ্যৎ নেই। সমাজতন্ত্র মানব ইতিহাসের সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজতন্ত্র দেখিয়ে দিয়েছে, তারা কী দিতে পারে। অনেকে জিজ্ঞেস করেন, সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? আমি বলি, পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ কী? যুক্তরাষ্ট্র একবার ভিয়েতনাম থেকে কমিউনিস্টদের হাতে মার খেয়ে পাততাড়ি গুটিয়েছিল। সর্বশেষ মৌলবাদী তালেবানদের হাতে মার খেয়ে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এটাই পুঁজিবাদের পতনের ঘণ্টাধ্বনি। পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থাও একদিনে আসেনি। যারা সমাজতন্ত্রের দিন শেষ হয়েছে বলেন, তারা এক হাতের বেশি দূরত্বে দেখতে পারেন না। বর্তমানই শেষ কথা নয়; শত শত বছরের ইতিহাস পরিক্রমায় একটি মুহূর্ত। আমরা থাকবো না। পরের প্রজন্ম লড়বে, লড়তেই হবে। মানবজাতি বেঁচে থাকলে পরিবর্তন হবেই; যদি পুঁজিবাদী বিশ্ব গোটা বিশ্বকে ধ্বংস করে না দেয়। তারা কেবল শ্রমিককে ধ্বংস করছে না। মানুষ ও পরিবেশকেও ধ্বংস করছে।’ এরপরও কয়েকবার উমর ভাইয়ের বাসায় গিয়েছি। একবার প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদও সঙ্গে ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের ‘বামপন্থার সুরতহাল’ বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দেয়া। সে সময়েও অনেক কথা হলো দেশ ও সমাজ নিয়ে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নিয়েও তিনি অনেক কথা বললেন।
চব্বিশের নির্বাচনের আগে একবার জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল আলোচনা সভার যোগ দিয়েছিলাম আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। সেখানে অন্য বক্তারা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বললেও উমর ভাই সাফ কথা বলে দিয়েছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচন বর্জন করলেই হবে না, প্রতিরোধ করতে হবে।’ কয়েক মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে গণ-অভ্যুত্থানে। বদরুদ্দীন উমর তার ৯৪ বছর বয়সে নিজের মতো করে একটি জীবনযাপন করে গেছেন, যেখানে কোনো আপস ছিল না। আত্মপ্রবঞ্চনা ছিল না। ছিল আত্মপ্রত্যয় ও আত্মজিজ্ঞাসা। উমর ভাই যে উপেক্ষার কথা বলেছেন, সেটা শুধু ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নয়। তিনি তো দেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কার স্বাধীনতা পদক পেয়েছিলেন, কিন্তু গ্রহণ করেননি। এর আগে বাংলা একাডেমিসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সব শেষে উমরের বাবা আবুল হাশিমের একটি কথোপকথন দিয়ে লেখাটির ইতি টানতে চাই। আবুল হাশিমের জন্ম বর্ধমানের জোতদার পরিবারে। সেখানে তাদের সম্পদের অভাব নেই। কিন্তু পঞ্চাশে এ দেশে এসে ভাড়া বাড়িতেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। সত্তর দশকের শুরুতে আবুল হাশিমের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার তো বয়স হয়েছে। কিন্তু কী রেখে যাচ্ছো।’ তিনি বাড়িঘরের ইঙ্গিত দিলেও আবুল হাশিম বন্ধুকে বললেন, ‘আমি উমরকে রেখে যাচ্ছি।’
উমর সত্যিই বাংলাদেশের সম্পদ ছিলেন, আছেন ও থাকবেন।