খো লা ক ল ম

দেশটা কারও একার না

গাজী আসাদুজ্জামান | মতামত
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫
দেশটা কারও একার না

দেশের চেয়ে কেউ বড় নয় 
দেশটা সবার আগে
দেশকে ভালোবাসতে হবে
গভীর অনুরাগে।
জাহাঙ্গীর আলমের ছড়া দিয়ে লেখাটি শুরু করছি। নানা ব্যস্ততার মধ্যে লেখার সময় হয়ে উঠে না। কিন্তু ইদানীং গুটিকয়েক মানুষের নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের কারণে লিখতে বিবেক বাধ্য করছে। আজ আমরা এক ক্রান্তিকাল সময় অতিক্রম করছি। দেশের মানুষের মধ্যে এখন এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। মানুষের মধ্যে শান্তি নেই। দেশের নানা প্রান্তে মব আর ভায়োলেন্সের ছড়াছড়ি। এর থেকে সাংবাদিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না। গাজীপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে মব সৃষ্টি করে আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যা করা হয়েছে। খোদ রাজধানীতে গত ২৯শে আগস্ট শুক্রবার কাকরাইলে জাতীয় পার্টির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের জেরে নুরুল ইসলাম নুরকে পিটিয়ে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামে চবি বিশ্ববিদ্যালয়ে চবি ছাত্র এবং জোবরা গ্রামের মানুষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে রাজবাড়ীতে নুরুল হক নুরালের লাশ পুড়িয়েছে একদল উচ্ছৃঙ্খল মানুষ। এরমধ্যে টাঙ্গাইলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বাসায় হামলা, ভাঙচুর চালিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। এ ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশে একটি সুন্দর, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন যাতে না হয় এ ঘটনাগুলো তারই বহিঃপ্রকাশ। তারই মহড়া।         

 

খোদ এনসিপি’র একটি জনসভায় প্রকাশ্যে এনসিপি’র এক নেতা বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। যেখানে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দেশে নির্বাচন হবে। সেখানে ওই নেতা কীভাবে বললেন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে- ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’। আমাদের সমাজে কিছু কিছু লোক আছে অতি বাড়াবাড়ি করছে- যা বলার নয়, তাই-ই বলছে। চিন্তা করছে না কোনটা বললে ভালো হবে, আর কোনটা বললে খারাপ হবে। যেখানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে, সেখানে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না- এনসিপি’র ওই নেতার এই বক্তব্য বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’র অবস্থা। ইদানীং এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামীর কিছু কিছু নেতাও নির্বাচন নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। দেশের মানুষ এই মুহূর্তে নির্বাচনের দিকে মুখিয়ে আছেন। তারা দেশে একটি শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে একটি স্থায়ী সরকার চান, যাতে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অস্থায়ী সরকার দীর্ঘদিন থাকতে পারে না। আর থাকার সেই সুযোগও নাই। 
৩৬শে জুলাইয়ের পর মানুষের মধ্যে একটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। মানুষ মনে করেছিল স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথর সরে গিয়ে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ এসেছে। তারা একটা নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা করছে। কিন্তু সূর্য উদয় হয়েছে ঠিকই, তবে ভোর কেটে যেতেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাটে অবরোধ-মিটিং-মিছিল শুরু হয়েছে। ঢাকা যেন দাবি-দাওয়া আদায়ের শহরে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে মবকাণ্ড দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। একটি বিশেষ মহল সুপরিকল্পিতভাবে ইস্যু সৃষ্টি করে মব ছড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। একসময় অন্তর্বর্তী সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করলেও বর্তমানে তা আবার আগের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে দ্রব্যমূল্যের এই বোঝা বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। মানুষ এখন আর ৩৬শে জুলাইয়ের চেতনায় নেই। তারা একটি ফেয়ার ইলেকশনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তারা চায় একটি নির্বাচিত সরকার। তারা চায় সুন্দর একটি নির্বাচন। যে নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে। যাতে দেশ মবের হাত থেকে রক্ষা পাবে, মানুষ তার বাকস্বাধীনতা ফিরে পাবে, স্বস্তির একটি নিঃশ্বাস নিতে পারবে। বেকারত্বের হ্রাস ঘটবে, বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আস্থা ফিরে পাবে। এরকম একটি বাংলাদেশই জনগণ কামনা করছে। জনগণ আর হতাশার মধ্যে হাবুডুবু খেতে চায় না। তারা নতুন একটি সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আছে। যে সূর্য ছিনিয়ে আনতে বহু মানুষকে আত্মাহূতি দিতে হয়েছে। 
 

গত সপ্তাহে ঈদে মিলাদুন্নবীর ছুটিতে দেশের বাড়ি গিয়েছিলাম। বিকাল বেলা বাজারে চায়ের দোকানে বসে আয়েশ করে গরুর দুধের মালাই চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় বাজারের সবেদ ডাক্তার এসে আমার পাশে বসলো। বহু দিনের পুরনো বন্ধু। ছোট বেলা থেকেই গলায় গলায় ভাব। একই সঙ্গে লেখাপড়া করেছি। আমাকে দেখে বললো- বন্ধু এবার নাকি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে? বাপ-দাদার আমল থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে আসলাম। এতে কোনো সমস্যা হলো না। এবার কি হলো যে, নির্বাচনে সংস্কার এলো? আগে ঢাকার বানান ইংরেজিতে ছিল উধপপধ। এরশাদ সরকার এসে উধপপধ কে উযধশধ করলো। এতে করে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের সব কাগজপত্র পরিবর্তন করতে হলো। সাইনবোর্ড পরিবর্তন করতে হলো। বই-পুস্তকেও পরিবর্তন করতে হলো। এতে কোটি কোটি টাকা খরচ হলো। এই সংস্কারের কোনো মানে হয়! আমরা সাধারণ মানুষ এই সংস্কারের পক্ষপাতী নই। খবরের কাগজে একটি নিউজ পড়লাম। একটি সংস্কার কমিশনে আপ্যায়ন খাতে খরচ হয়েছে নাকি কোটি টাকারও বেশি। এক সংস্কার কমিশনে যদি আপ্যায়ন খাতে কোটি টাকা খরচ হয় আরও তো সংস্কার কমিশন আছে। তাতে আর কতো কোটি টাকা খরচ হবে তার তো কোনো ইয়ত্তা নেই। যে সংস্কারে আমাদের পেট ভরবে না, চাকরির বাজার সম্প্রসারিত হবে না, মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন হবে না-  সেই সংস্কার আমরা চাই না। আমরা চাই দেশে একটি শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ, প্রত্যেক দলের অংশগ্রহণমূলক স্বচ্ছ নির্বাচন। আমাদের এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা নেই। গায়ের জোরে মব, ভায়োলেন্স আর পেশীশক্তির নির্বাচন চাই না। যারা এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাচ্ছে না তাদের একটা অশুভ উদ্দেশ্য রয়েছে। তারা বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে নির্বাচনে গেলে তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। তাই তারা নির্বাচন নিয়ে পানি ঘোলা করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি একটি গোষ্ঠী।
 

ইদানীং একটি ছবিতে আনোয়ার হোসেনের ঠোঁট মেলানো গান আমার খুব গাইতে ইচ্ছা করছে। গানটি হলো- তোরা দেখ, দেখ রে চাহিয়া/রাস্তা দিয়া হাইটা চলে রাস্তা হারাইয়া...। আমরা মনে হয় নির্বাচনের রাস্তা হারিয়ে ফেলছি। আমরা বর্তমানে নির্বাচনের রাস্তায় হাঁটছি না ভিন্ন পথে হাঁটছি-এই গানের মতোই আমাদের নির্বাচনের অবস্থা। যেহেতু প্রধান উপদেষ্টা বললেন- ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নির্বাচন হবে। কিন্তু এনসিপি ও জামায়াতের সুর ভিন্ন। তারা নির্বাচন নিয়ে একেক সময় একেক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। একবার বলছেন, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। আবার বলছেন, এমআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আমরা অংশগ্রহণ করবো।     
বাংলাদেশে শুরু থেকেই নির্বাচন হচ্ছে- জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে। এই দুই পদ্ধতিতে নির্বাচন ছাড়া অন্যকোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়নি। বাংলাদেশের জনগণও এই দুই পদ্ধতির নির্বাচনে অভ্যস্ত। তারা বিতর্কে যেতে চায় না। বিতর্ক যত বাড়বে ততই দেশ অরাজকতার পথে ধাবিত হবে। জনগণ আর অরাজকতার পথে যেতে যায় না। তারা একটি স্বচ্ছ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চান। দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে আর কোনো বিতর্কে না গিয়ে আমাদের ফেব্রুয়ারির এই নির্বাচনকে স্বাগত জানানো উচিত। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে- দেশটা কারও বাপের না/দেশটা কারও একার না/দেশটাকে ভালোবাসতে হবে/দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে- তাহলেই বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল। আমাদের আগামীর স্লোগান হোক ‘আমরা সবাই দেশকে ভালোবাসি’। 
 

মতামত'র অন্যান্য খবর