বাংলাদেশের রাজনীতি রক্তে রঞ্জিত ইতিহাসের আরেক নাম। গণ-অভ্যুত্থান, আন্দোলন, বিদ্রোহ আর আত্মত্যাগে সাধারণ মানুষ বারবার জীবন উৎসর্গ করেছে মুক্তির আশায়। প্রতিবারই তাদের প্রত্যাশা ছিল-এবার শোষণের অবসান হবে, গড়ে উঠবে ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, সেই আত্মদান বহুবার রূপ নিয়েছে কেবল শাসকের পালাবদলে; কাঠামো অপরিবর্তিত থেকেছে, ঘুরে-ফিরে কেবল বদলেছে মুখ। জনগণের রক্ত, ঘাম ও অশ্রুতে লেখা স্বপ্নগুলো তাই বারবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। এখানেই দাঁড়ায় একটি মৌলিক প্রশ্ন- বাংলাদেশের রাজনীতি কি প্রকৃত পরিবর্তনের পথে, নাকি আমরা কেবল পুনরাবৃত্তির চক্রে বন্দি? পরিবর্তন মানে কেবল শাসক পরিবর্তন নয়; বরং রাষ্ট্রের নৈতিকভিত্তি, সাংবিধানিক কাঠামো ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনর্গঠন। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, গণ-আন্দোলনের বিজয় প্রায়ই নতুন প্রভুর উত্থানেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, যেখানে পুরনো নিপীড়ন ব্যবস্থাই ভিন্নরূপে টিকে গেছে।
তাহলে কি বাংলাদেশের ইতিহাস ‘অতীতের পুনরাবৃত্তি’র এক অন্তহীন চক্র? যেখানে হেগেলের মতে-ইতিহাস বারবার ফিরে আসে নতুন রূপে, মার্কসের ভাষায়-প্রথমে ট্র্যাজেডি, পরে প্রহসন আকারে আত্মপ্রকাশ করে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল মহা-ট্র্যাজেডি, ’৯০-এর গণ-আন্দোলন পরিণত হয় প্রহসনে, আর ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান তুলেছে নতুন প্রশ্ন-আমরা কি আবারো পুরনো প্রহসনের পুনরাবৃত্তি দেখবো, নাকি জনগণের আত্মত্যাগ থেকে সত্যিকারের রূপান্তর ঘটবে? যেখানে গণতন্ত্র, মানবিকমর্যাদা ও নৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এ যেন পৌনঃপুনিক দ্বন্দ্ব।
মুক্তিযুদ্ধ ও অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি: ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কেবল ভূখণ্ডের স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়; এটি ছিল নৈতিক ও রাজনৈতিক এক বিপ্লব, যেখানে ছিলো-গণমানুষের শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা। অগণিত প্রাণের আত্মদান, নিঃস্বার্থ ত্যাগ এবং অসীম সংগ্রামের ভেতরে নিহিত ছিল মৌলিক এক প্রত্যাশা-রাষ্ট্র হবে জনগণের, ক্ষমতা ফিরে আসবে তাদের হাতে এবং রাষ্ট্রের নীতি ও কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে থাকবে মানবিকমর্যাদা, নৈতিকতা ও ন্যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি প্রহর ছিলো-কেবলই অস্ত্রের লড়াই নয়, বরং নৈতিক-আদর্শের প্রতি অবিচল প্রতিজ্ঞা, জনগণের স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগের নিখাদ চেতনা। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক অর্জন নয়; এটি নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্বের এক দুরন্ত সূচনা। যেখানে রাষ্ট্রের শক্তি জনগণের কল্যাণে প্রতিফলিত হবে। এই বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে আমরা শিখি-সত্যিকার স্বাধীনতা আসে শুধুমাত্র ক্ষমতার পুনর্বণ্টন, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং মানবিকমর্যাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার মধ্যদিয়ে। যা আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অর্জিত হয়নি।
শুরু থেকেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থকে ঘিরে। একদলীয় স্বৈরশাসন, ক্রমাগত সামরিকশাসন, দুর্নীতি আর লুণ্ঠনের সংস্কৃতি-মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপ্নকে ভেঙে দেয়। শোষণ কেবল নতুন প্রভুর হাতে পুনরাবৃত্ত হয়; জনগণের মুক্তি আসেনি।
অতএব, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। কারণ, জনগণের আকাঙ্ক্ষিত ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয়নি। এই অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি কেবল অতীতের বিশ্বাসঘাতকতা নয়; এটি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক অনন্ত প্রশ্ন।
’৯০-এর গণ-আন্দোলন: ’৭১-এর পর বাংলাদেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়ের নাম-১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন। সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এরশাদ সরকারের পতনের পথ প্রশস্ত করে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল-এবার প্রতিষ্ঠিত হবে প্রকৃত গণতন্ত্র। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্র দ্রুতই প্রতিহিংসা, দলীয়করণ ও সাংবিধানিক অপব্যবহারের জালে আটকে যায়। এরশাদ পতনের পর পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হলেও তা পুনরাবৃত্তির ফাঁদে বন্দি হয়। জনগণের আত্মত্যাগ আবারো পরিণত হয় বিশ্বাসঘাতকতায়। গণতন্ত্র রয়ে যায় কেবল সভা-সেমিনার-বক্তব্য-বিবৃতি-কাগজ ও কলমের খোলসে।
সামপ্রতিক রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থান: ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তাক্ত নতুন এক বাঁকচিহ্ন। ভোটাধিকার হরণ, দমননীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। তরুণদের রক্তে রাজপথ ভেসে যায়। জনগণ লড়েছিল কেবল শাসক পরিবর্তনের জন্য নয়-রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য।
ছাত্র-জনতার বিস্ময় জাগানিয়া লড়াইয়ে অবশেষে শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটে। কিন্তু বড় প্রশ্ন রয়ে যায়-এই আত্মত্যাগ কি সত্যিই রাষ্ট্রকে রূপান্তর করবে, নাকি আবারো পুরনো মুখোশে ফিরবে কর্তৃত্ববাদ? এখনো কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের আকাঙ্ক্ষার পূর্ণাঙ্গ দর্শন হাজির করতে পারেনি, বরং আবার মাথা তুলছে দুর্নীতি ও ক্ষমতার লোভ।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নাকি রূপান্তর: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনটি বাঁকচিহ্ন-১৯৭১, ১৯৯০ ও ২০২৪। প্রতিবারই জনগণ রক্ত দিয়ে শাসক উৎখাত করেছে, কিন্তু প্রতিবারই প্রশ্ন রয়ে গেছে-রূপান্তর ঘটলো, নাকি পুনরাবৃত্তি? হেগেল বলেছিলেন-‘ইতিহাস ফিরে আসে নতুন রূপে।’ মার্কস বলেছিলেন-‘প্রথমে ট্র্যাজেডি, পরে প্রহসন।’ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিই সত্য হচ্ছে।
হান্না আরেন্ট দেখিয়েছিলেন-‘রাষ্ট্রযন্ত্র প্রায়শই অমানবিকতাকে রুটিনে পরিণত করে।’ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাও তাই। জনগণের আত্মত্যাগকে দলগুলো ব্যবহার করেছে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে, কিন্তু জনগণের নৈতিক মালিকানা কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে আত্মত্যাগ হয়েছে অগাধ, কিন্তু রাষ্ট্র হয়েছে নৈতিকভাবে শূন্য।
জন রলসের ন্যায়ভিত্তিক গণতন্ত্র বা অমর্ত্য সেনের স্বাধীনতার ধারণা দিয়ে দেখলে বোঝা যায়-বাংলাদেশে গণতন্ত্র কাগজে-কলমে থাকলেও তার ভেতরে ন্যায়, সমতা ও মর্যাদা অনুপস্থিত। তাই এই গণতন্ত্র জনগণের আত্মত্যাগের সঙ্গে প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশের পুনরাবৃত্ত সংকটের মূল কারণ বিকৃত রাজনৈতিক-সংস্কৃতি। ব্যক্তিগত, দলগত ও পারিবারিক স্বার্থে রাষ্ট্রকে দেখা এবং ক্ষমতা দখলের নিয়ন্ত্রণহীন প্রবণতা এক নিষ্ঠুর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সমাজের দায়িত্ব অস্বীকার, রাষ্ট্রীয় সম্পদ তসরুপ এবং জনগণকে বশীভূত রাখার মনোবৃত্তিই এই দুর্দশার মূল চালিকাশক্তি। জনাকাঙ্ক্ষার বিরোধিতার সংস্কৃতি ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়, গণতান্ত্রিক চর্চা দুর্বল হয়। এই বৈকল্যসংস্কৃতি না বদলালে রাষ্ট্রকে নৈতিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রকে কেবল প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে নয়, একে নৈতিক প্রকল্প হিসেবে ভাবতে হবে। শাসনের কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে মানবিকমর্যাদা, সাম্য, ন্যায় ও নৈতিকতাভিত্তিক। “নৈতিক প্রজাতন্ত্র” ধারণা তাই অপরিহার্য-এটি কেবল সরকার পরিবর্তনের স্বপ্ন নয়, বরং রাষ্ট্রকে নৈতিকভাবে পুনর্গঠন করার প্রস্তাব।
অতীত প্রমাণ করে-জনগণের আত্মত্যাগ অগাধ, কিন্তু নৈতিকরূপান্তর অপর্যাপ্ত। এখন প্রশ্ন একটাই-আমরা কি পুনরাবৃত্তির ফাঁদ থেকে বের হতে পারবো, নাকি আবারো পুরনো খেলা চলবে নতুন মুখোশে? উত্তর নির্ভর করছে, রাষ্ট্রকে আমরা কেবল ক্ষমতার যন্ত্র হিসেবেই রাখবো, নাকি তাকে ‘নৈতিক প্রজাতন্ত্রে’ রূপান্তর করবো।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com