তী র্য ক ম ন্ত ব্য

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠন সংকট ও সম্ভাবনা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী | মতামত
অক্টোবর ১২, ২০২৫
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠন সংকট ও সম্ভাবনা

গণ-অভ্যুত্থান হলো রাষ্ট্র ও সমাজের বিদ্যমান কাঠামোর প্রতি জনগণের সম্মিলিত অনাস্থা, ক্ষোভ ও আকাঙ্ক্ষার প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ। এটি জনগণের আত্মত্যাগ, রক্ত এবং অদম্য সাহসের মধ্যদিয়ে শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। অভ্যুত্থানের সাফল্যের পর জন্ম নেয় আকাশচুম্বী প্রত্যাশা-শোষণ ও বঞ্চনার অবসান হবে, বৈষম্য বিলুপ্ত হবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু রাতারাতি রাষ্ট্র বদলে যায় না। কারণ, রাষ্ট্র কেবল শাসকের পতন নয়, বরং এক দীর্ঘস্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক এবং নৈতিক কাঠামোর জটিল মিশ্রণ। তাই অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রে তিনটি মৌলিক সংকট সৃষ্টি হয়: কাঠামোগত শূন্যতা, নৈতিক সংকট এবং বৈধতার সংকট। রাজনৈতিক দর্শনের তাত্ত্বিকতায় সংকটগুলো বিশ্লেষণ করলে নীতিনির্ধারক ও জনগণ-উভয়ই উপকৃত হবে।


কাঠামোগত শূন্যতা: গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুরনো ক্ষমতা-কাঠামো ভেঙে পড়ে। যদি বিকল্প রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও শাসনযন্ত্র সুসংগঠিত না থাকে, তবে রাষ্ট্র “অরাজকতার শূন্যতা”-তে পতিত হয়। দার্শনিক থমাস হবস তার ‘লেভিয়াথান’-এ বলেছিলেন-কেন্দ্রীয়শক্তি দুর্বল হলে সমাজে ‘সবার বিরুদ্ধে সবার যুদ্ধ’ শুরু হয়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী ক্ষমতার এই শূন্যতা রাষ্ট্রকে সেই বিপদের দিকে ঠেলে দেয়।
আন্তোনিও গ্রামশি এই অবস্থাকে ‘ইন্টাররেগনাম’ (Interregnum) বলেছেন। এটি এমন এক মধ্যবর্তী সময়, যখন পুরনো ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে, কিন্তু নতুনশক্তি বা মতাদর্শ তখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই দোদুল্যমান অবস্থায় রাষ্ট্র ও সমাজ এক ধরনের অচলাবস্থায় থাকে; শাসনযন্ত্র দুর্বল হয়, আইনশৃঙ্খলা অনিশ্চিত হয় এবং জনগণ নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। এই সময়ে নানা অস্থায়ীশক্তি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও স্থিতিশীলতা আসে না।
 

নৈতিক সংকট: গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো জনগণের আত্মত্যাগ ও রক্তের নৈতিকভিত্তি। এই নৈতিকশক্তি একটি বৃহত্তর আদর্শের জন্য মানুষের স্বেচ্ছাকৃত ত্যাগ থেকে জন্ম নেয়, যা আন্দোলনকে নৈতিকবৈধতা প্রদান করে। হান্না আরেন্ট তার ‘অন রেভলিউশন’-এ বলেছেন-বিপ্লব তখনই ব্যর্থ হয় যখন এর নৈতিকশক্তিকে নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানে প্রবাহিত করা না যায়। জনগণের নৈতিকজাগরণ যদি আমলাতান্ত্রিক জড়তা, ব্যক্তিস্বার্থ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তবে মানুষের প্রত্যাশা-হতাশায় পরিণত হয়। জন রলস তার ‘আ থিওরি অব জাস্টিস’-এ যুক্তি দিয়েছেন-ন্যায়সঙ্গত প্রতিষ্ঠানই জনগণের আস্থার একমাত্র উৎস। যদি অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্রে ন্যায়, সমতা ও জবাবদিহির ওপর ভিত্তি করে নতুন কাঠামো গড়ে না ওঠে, তবে সেই নৈতিকভিত্তি ভেঙে যায় এবং জনগণের আস্থা ক্ষয় হতে থাকে।
 

বৈধতার সংকট: একটি শাসনব্যবস্থা তখনই বৈধ বলে গণ্য হয়, যখন জনগণ স্বেচ্ছায় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। অভ্যুত্থান, পুরনো শাসনের বৈধতাকে ভেঙে দেয়, কিন্তু নতুন শাসনকে অবশ্যই জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বৈধতা পুনর্গঠন করতে হয়। ম্যাক্স ভেবারের মতে-শাসনের টেকসই বৈধতা আসে আইনগত ও যুক্তিনিষ্ঠ শাসনব্যবস্থা থেকে, কেবল ক্যারিশমা বা সাময়িক জনপ্রিয়তা থেকে নয়। জ্যাঁ-জাক রুশো তার ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’-এ দেখিয়েছেন- বৈধতা তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন রাষ্ট্র জনগণের ‘সাধারণ ইচ্ছা’ প্রতিফলিত করে। যদি নতুন শাসনব্যবস্থা কেবল শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছা প্রতিফলিত করে, তবে তা তার বৈধতা দ্রুত হারায়। অভ্যুত্থানের পর আইন, ন্যায় এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই নতুন বৈধতা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে রাষ্ট্র অস্থিতিশীলতার ঝুঁকিতে পড়ে। ?গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য থাকে একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং নতুন করে একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় প্রায়শই কিছু অন্তরায় দেখা যায়:-


নেতৃত্বের সংকট: অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রায়শই সেই পুরনো গোষ্ঠী বা নতুন করে উঠে আসা এমন নেতৃত্বের হাতে চলে যায়, যারা জনগণের প্রকৃত অভিপ্রায় বুঝতে বা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়।
 

প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতিরোধ: রাষ্ট্রের ভেতরে থাকা প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যেমন আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী বা অর্থনৈতিকশক্তি-নতুন পরিবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় পুরনো কাঠামো ধরে রাখতে চায়।
 

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: অভ্যুত্থানের পর প্রায়শই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই দ্রুত ও সুনির্দিষ্টভাবে জনগণের অভিপ্রায়কে কার্যকর নীতি ও প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে হবে। দার্শনিক তত্ত্বের আলোকে এই উত্তরণের পথরেখা নিম্নরূপ:-
 

১. কাঠামোগত শূন্যতা পূরণে প্রাতিষ্ঠানিক জরুরি সংস্কার: কাঠামোগত শূন্যতা পূরণের জন্য প্রয়োজন অস্থায়ী কিন্তু শক্তিশালী সাংবিধানিক ব্যবস্থা এবং জরুরি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এটি গ্রামশির ‘ইন্টাররেগনাম’ (মধ্যবর্তী সময়)-কে স্থিতিশীল করার মূল পদক্ষেপ।
 

অস্থায়ী সাংবিধানিক কাঠামো: অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারকে একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে, যার মধ্যে তারা কেবল নির্বাচনকালীন ও জরুরি সংস্কারমূলক কাজ সম্পন্ন করবে। এই কাঠামো নিশ্চিত করবে যে, ক্ষমতা যেনো দীর্ঘমেয়াদি না হয় এবং দ্রুত বৈধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।


আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষকরণ: রাষ্ট্রের প্রশাসনিকযন্ত্রকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণের আস্থা ফেরাতে দ্রুত একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
 

২. নৈতিক শক্তি সংরক্ষণে স্বচ্ছতা ও বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা: জনগণের নৈতিকশক্তিকে স্থায়ী রাষ্ট্রে প্রবাহিত করার মূলভিত্তি হলো স্বচ্ছতা ও বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা। এটি হান্না আরেন্টের ‘বিপ্লবের নৈতিক শক্তি’কে বাস্তবায়নের একমাত্র পথ।
 

স্বচ্ছতার প্রতিজ্ঞা: নতুন সরকারকে অবশ্যই সম্পদ প্রকাশ এবং গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও নিয়োগে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার (Zero Tolerance) নীতি কেবল ঘোষণায় নয়, কার্যকর আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
 

বিচার বিভাগীয় পুনর্বহাল: বিচার-বিভাগকে নির্বাহী-বিভাগ থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে ন্যায়বিচারের দ্রুততা ও নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে, যা জনগণের আস্থা ও নৈতিকভিত্তিকে মজবুত করবে।
 

৩. বৈধতা পুনর্গঠনে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও বিকেন্দ্রীকরণ: কেবল কেন্দ্রীয় নির্বাচন নয়, জনগণের ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (General Will) প্রতিফলিত করার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। এটি ম্যাক্স ভেবারের ‘যুক্তিনিষ্ঠ বৈধতা’ এবং রুশোর ‘সাধারণ ইচ্ছা’ ধারণাকে বাস্তব রূপ দেবে।
 

স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্র থেকে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এতে জনগণ নিজেদের সমস্যা সমাধানে সরাসরি অংশ নিতে পারবে এবং শাসনব্যবস্থার প্রতি মালিকানা ও বৈধতা অনুভব করবে।
 

রাজনৈতিক সংলাপ ও ঐকমত্য: একটি জাতীয় সংলাপ মঞ্চ তৈরি করা উচিত, যেখানে সকল অংশীজন দেশের মৌলিক বিষয়ে একটি সর্বসম্মত ন্যূনতম কাঠামো (Minimum Consensus Framework) তৈরি করতে পারবে। এটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমিয়ে নতুন বৈধতার ভিত্তি স্থাপন করবে।


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানই (১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪) ছিল জনগণের আত্মত্যাগ ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রকে এই তিনটি সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
 

১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর পাকিস্তানি শাসন-কাঠামো ভেঙে গেলেও নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল দুর্বল। অর্থনৈতিক সংকট, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার অভাব এবং রাজনৈতিক বিভাজন দ্রুত প্রকাশ পায়। শুধু স্বাধীনতা অর্জন নয়, বরং স্বাধীনতার পর একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য ছিল।


১৯৯০: স্বৈরাচার পতনের পর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলেও সামরিক-প্রশাসনিক কাঠামো অক্ষত থেকে যাওয়ায় প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। স্বৈরশাসকের অপসারণ করলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, এর জন্য প্রয়োজন গভীর কাঠামোগত সংস্কার ও নৈতিক জবাবদিহিতা।
 

২০২৪: সর্বশেষ গণ-অভ্যুত্থান আবারো স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিবাদী পুরনো শাসন ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার শূন্যতা এখনো পূর্ণ হয়নি এবং সেই শূন্যতায় নানা শক্তি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রকে এখনই বৈধতা, নৈতিকতা ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে হবে, তা না হলে মানুষের প্রত্যাশা আবারো হতাশায় পরিণত হবে। গণ-অভ্যুত্থান কেবল সূচনা, শেষ নয়। এর প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করে-রাষ্ট্র কতো দ্রুত ও সুনির্দিষ্টভাবে জনগণের অভিপ্রায়কে কার্যকর নীতি ও প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে পারে তার ওপর। থমাস হবস আমাদের অরাজকতার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন আর গ্রামশি এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক চিন্তাবিদরা দেখান-কীভাবে সেই শূন্যতাকে রূপান্তরিত করে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। 
 

লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
faraizees@gmail.com 

মতামত'র অন্যান্য খবর