সা ফ ক থা

ছাত্র সংসদ ও ছাত্র রাজনীতি

মোজাম্মেল হোসেন | মতামত
অক্টোবর ১১, ২০২৫
ছাত্র সংসদ ও ছাত্র রাজনীতি

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ যথাক্রমে ডাকসু ও জাকসু’র নির্বাচন হয়েছে ৯ ও ১১ই সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু ও রাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে যথাক্রমে ১৫ ও ১৬ই অক্টোবর। এই দুটো নির্বাচনের তারিখ স্থির করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। রাকসু’র ভোটগ্রহণের দিন তো ঠিক হয়েছে চার দফা রদবদলের পরে। 
আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের নির্বাচন দীর্ঘ তিন দশক বন্ধ ছিল। এগুলোর কার্যক্রম হয়নি। ২৯ বছরের ব্যবধানে ডাকসু নির্বাচন ২০১৯ সালে একবার হয়ে আবার ৬ বছর ফাঁকা। অন্যগুলোর হিসাব যদি নেই তাহলে দেখি জাকসুু নির্বাচন হয়েছে ৩৩ বছর পরে, আর চাকসু ও রাকসু হতে যাচ্ছে ৩৫ বছর পরে। 


দীর্ঘদিন পরে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে বা নির্বাচিত ছাত্র সংসদ সক্রিয় হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে অতীব সুসংবাদ। নির্বাচিত ছাত্র সংসদ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে না, স্নাতক শিক্ষার কলেজগুলোতে থাকার কথা। এক সময় তা ছিল। এই তিন দশকের দুরবস্থা যে কলেজগুলোতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। এই পটভূমিতে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল যে কেন তিন দশক ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো হয়নি? নির্বাচন না হওয়ায় আমাদের কী ক্ষতি হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবের উপর নির্ভর করবে এটা বোঝা যে, এরপর প্রতি বছর নিয়মিত নির্বাচনগুলো হবে তো? না-কি আবার বিষয়টা অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। নির্বাচিত সংসদগুলো কাঙ্ক্ষিত ও আদর্শ ভূমিকা পালন করতে পারবে তো, যা থেকে ছাত্রসমাজ ও দেশ উপকৃত হবে? না-কি প্রতিষ্ঠানগুলোর আবার অপব্যবহার হবে, বিকৃতি ঘটবে, যে কারণে তিরিশ বছরের বেশি সময় নির্বাচন হয়নি?


জানা আছে যে, ক্যাম্পাসের নির্বাচনে প্রচলিত রাজনৈতিক দলীয় ধারার ছাত্র সংগঠনগুলো মুখ্য ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাগজে-কলমে জাতীয়ভিত্তিক ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশক্তি প্রভৃতি সংগঠনকে স্বীকৃতি দেয় না। কিন্তু সর্বোতভাবে ব্যবহারিক ও বাস্তবে স্বীকার করে নিয়েই কাজ করে। ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনে একটি স্থানীয় ও সাময়িক নাম দিয়ে প্রার্থীদের প্যানেল পরিচিতি দেয়, যেমন ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ বা ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ বা ‘রাকসু ফর র‌্যাডিক্যাল চেঞ্জ’ ইত্যাদি। সংবাদমাধ্যমও খবর পরিবেশন করে প্রতিবার শিবির সমর্থিত বা ছাত্রদল সমর্থিত বা বামপন্থি অমুক তমুক প্যানেল বলে। এভাবে ভাবের ঘরে চুরি চলমান। 
এবারের ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফল দেশে বিরাট চমক সৃষ্টি করেছে। তা হলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর যে ছাত্রফ্রন্ট ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে কখনো প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কাজ চালাতে পারেনি, গোপনে থেকেছে, অন্য সংগঠনে ঢুকে ছদ্মবেশে কাজ করেছে তারা বিপুলভাবে জয়ী হয়েছে। আর গত বছর জুলাই-আগস্টে রক্তাক্ত ছাত্র অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে তাদের সহযোগী ছাত্রলীগ আইনত নিষিদ্ধ থাকায় এখন বিএনপি’র সহযোগী ছাত্রদলকে সবচেয়ে বড় সংগঠন মনে করা হলেও তারা গো-হারা হেরেছে। এই ফলাফলের বিভিন্ন রকম বিশ্লেষণ হয়েছে, অব্যাহতভাবে হচ্ছে। ব্যালট পেপার ছাপানোর ব্যবস্থাপনা ও গণনায় ত্রুটি এবং সরকার পরিবর্তনের পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে জামায়াতপন্থিদের প্রাধান্য প্রভৃতি অভিযোগ মেনে নিলেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও বিপুল সংখ্যক ভোটার উপস্থিতির নিরিখে নির্বাচনের ফলাফল সার্বিকভাবে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নেই। ছাত্র-তরুণদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার প্রসার ঘটলে তার কারণ ও স্বরূপ অনুধাবন করে করণীয় নির্ধারণ ও কাজে নামতে হবে প্রগতিকামীদের। 


আরও যে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করার তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে দেশের রাজনৈতিক, একাডেমিক ও সামাজিক নেতারা কোন্‌্‌ দৃষ্টিতে দেখবেন? কীভাবে সাহায্য করবেন? কতোটুকু জড়িত হবেন? আমরা দেখলাম ডাকসু নির্বাচনের সময় প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আমাদের খবরের কাগজ, টেলিভিশন, অনলাইন প্রভৃতি সকল সংবাদমাধ্যমের কাছে যেন এটাই দেশের সবচেয়ে বড় খবর। দিনের পর দিন বড় বড় শিরোনাম ও কেবলই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর লাভালাভের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল থেকে কোন্‌ রাজনৈতিক দল কতোটুকু লাভবান হবে, ছাত্রদের এই নির্বাচন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কীভাবে কতোটুকু প্রভাবিত করবে ইত্যাদি আলোচনায় অধিকাংশ কলাম লেখক ও টকশো’র আলোচকরা মশগুল। এই প্রবণতা ও চিন্তা-ভাবনার প্যাটার্নকে কিছুতেই স্বাভাবিক ও কল্যাণকর বলা চলে না। সংবাদমাধ্যমে অতি প্রচার ও প্রচারের এই ধারাটির সঙ্গে ডাকসু’র অতি রাজনীতিকায়নের বিষয়টি জড়িত। ‘জনতার চোখ’-এ গত ১৩ই সেপ্টেম্বর আমি ‘ডাকসু নির্বাচনের অতি রাজনীতিকায়ন’ শিরোনামে একটি লেখায় এ বিষয়ে সম্মানিত পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। আমরা লক্ষ্য করেছি ডাকসু-জাকসু নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের রীতিমতো মাঠে নেমে সক্রিয়তা, ভোট গণনার সময় ক্যাম্পাসের কাছে ভিড় করা ইত্যাদি। উল্লেখ করেছিলাম শিবির জয়লাভ করায় সুদূর পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দেয়ার বিষয়টি। 


আমার আবেদন ছিল এই বিষয়ের প্রতি সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদের মূল কাজ কী? সেই কাজ গৌণ রেখে আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অতি রাজনীতিকায়নে কী সুফল লাভ করবো? 
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের নিজস্ব গঠনতন্ত্র আছে। ওয়েবসাইটে এখন তা সর্বসাধারণের জন্যই উন্মুক্ত আছে। ছাত্র সংসদের কাজকে আমরা বলতে পারি পাঠ-অতিরিক্ত কার্যক্রম বা এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটি। নিয়মিত শিক্ষা লাভের মতোই নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশ, ক্রীড়া ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি, প্রয়োজনে দুর্গত মানুষের সেবা প্রভৃতির আয়োজন করা। এসবের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠা ও নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জনই মুখ্য উদ্দেশ্য। এই কাজগুলো করার অর্থ কি রাজনীতি পরিত্যাগ করা? না। দেশের রাজনীতি থেকে ছাত্র সমাজকে আমরা বিচ্ছিন্ন করে ভাবতে পারি না, সেভাবে দেখতেও চাই না। উচ্চশিক্ষার ছাত্ররা প্রাপ্তবয়স্ক। ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সকল নাগরিক ভোটদাতা। ছাত্ররা সরাসরি নিজ নিজ পছন্দের রাজনৈতিক দলের সদস্য হতেও পারেন। তা যদি না-ও হন, তবু প্রতিটি ছাত্রের রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে বাধা নেই। বরং হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আর বিশেষ করে আমাদের মতো সাবেক উপনিবেশ তথা তৃতীয় বিশ্ব বা অনুন্নত দেশে যেখানে শিক্ষার হার কম সেসব দেশে ছাত্ররা অধিক সচেতন বলে রাজনৈতিক চিন্তায়ও তারা এগিয়ে এবং তারা দেশবাসীকেও সচেতন করে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লাইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আমাদের ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬০-এর দশকের পাকিস্তানি আইউব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের আন্দোলন ও সর্বোপরি স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৩-৯০ সময়ে এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ে উৎখাত করেছে। এই পুরো সময় ডাকসু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি-ক্রীড়া আয়োজনের মূল দায়িত্বের পাশাপাশি সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ’৫০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশক্তি প্রভৃতি সংগঠনই ছিল। ছাত্রদের ভূমিকাকে তখন সাধারণভাবে বলা হতো ছাত্র আন্দোলন, বর্তমানের মতো ‘ছাত্র রাজনীতি’ নয়। গোটা ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে আমরা দেখি ছাত্ররা গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পক্ষে, আগে দেখেছি ভিয়েতনামের পক্ষে, যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে, বিশ্বশান্তির পক্ষে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে। ওই সব দেশের ছাত্ররা কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় নয়। আমাদের দেশে ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক দলের লেজুড় হয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলাদলি-খুনোখুনি শুরু হয় ১৯৯০-এর দশক থেকে। এর জন্য দায়ী প্রধানত যে দু’টি দল ক্ষমতায় গিয়েছে সেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। 


দেখা গেছে, ডাকসুতে সাধারণত সরকারবিরোধী মনোভাব থেকে ছাত্ররা ভোট দেয়। কারণ তরুণরা প্রথাবিরোধী, তরুণ মন বিদ্রোহী মন। তাই ১৯৯০ পর্যন্ত নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন হয়ে এলেও ১৯৯১ সালে বিএনপি নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসার পর থেকে আর ডাকসু নির্বাচন হতে দিলো না। পরে আওয়ামী লীগও এই রীতি অনুসরণ করলো। যে দল যখন ক্ষমতায় সেই দলের অনুসারী ছাত্র সংগঠন, ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ, তখন সেই দলের ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী। এই সময়ে এই লেজুড় বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে বন্ধ করার জন্য অনেক দাবি উঠেছে, আলোচনা হয়েছে। দল দু’টি সব সময় ‘ছাত্র আন্দোলনের অতীত গৌরব’  স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই দাবি অগ্রাহ্য করেছে। এখন প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার শুধু ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে লেজুড় বৃত্তির কোনো সমাধান না করে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন শুরু করে দিলেন। আমরা কি দেখতে পাবো যে, ছাত্র সংসদগুলো তাদের মূল কাজ মনোযোগ দিয়ে করছে এবং দলীয় ঠেঙ্গাড়ে বাহিনীর ভূমিকা পরিত্যাগ করেছে? 

মতামত'র অন্যান্য খবর