প্রবাসের চিঠি

লজ্জার আয়নায় বাংলাদেশের মুখ

নিয়াজ মাহমুদ | মতামত
অক্টোবর ২৫, ২০২৫
লজ্জার আয়নায় বাংলাদেশের মুখ

নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায়, জাতিসংঘের সামনে, কিংবা জ্যাকসন হাইটসের ভিড়ে সমপ্রতি যা ঘটলো তা নিছক কোনো ‘ঘটনা’ নয়, বরং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আয়না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও এনসিপি নেতা আকতার হোসেনকে প্রকাশ্যে হেনস্তা করা যেন এক অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অংশ।
১৮, ২২ ও ২৬শে সেপ্টেম্বর-এই তিনদিনে নিউ ইয়র্কের মাটিতে যা ঘটেছে, তা শুধু বিদেশে নয়, বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও কলঙ্কিত করেছে।
বাংলায় প্রবাদ আছে- “সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিবো কোথা?”
প্রবাসী রাজনীতি আজ সেই দশায়।
আজ এনসিপি’র নেতা আক্রান্ত, কাল বিএনপি’র, পরশু আওয়ামী লীগের-চক্রটা ঘুরেই চলছে।
কেউ প্রতিবাদ করে, কিন্তু কেউ আত্মসমালোচনা করে না। আমেরিকার মাটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বিশৃঙ্খলার স্বাধীনতা নেই।
ডিম ছোড়া, ঠেলা-ধাক্কা, হাতাহাতি-এগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, অসভ্যতার প্রকাশ।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের বিধান স্পষ্ট- দেশের বাইরে কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা খোলা যাবে না।
কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রে “আওয়ামী লীগ ইউএসএ শাখা”, “বিএনপি ইউকে ইউনিট”, “ছাত্রলীগ কানাডা শাখা”-সবই চলছে দিব্যি। আইন নিষেধ করেছে, দল অনুমোদন দিয়েছে।
সত্তরের দশকে প্রবাসী রাজনীতির শুরুটা ছিল দেশপ্রেমের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়ানো, দেশের জন্য লবিং, অর্থ সংগ্রহ-এই ছিল উদ্দেশ্য।
কিন্তু এখন?
এখন প্রবাসী রাজনীতি মানেই পদ-পদবি, কমিটি, টেনশন আর তহবিলের রাজনীতি।
এক শহরে একই দলের তিনটি কমিটি, তিনজন সভাপতি-সবাই বৈধ, সবাই অবৈধ।
ভারত, পাকিস্তান পারে-আমরা কেন পারি না? ভারতের কংগ্রেস বা বিজেপি, পাকিস্তানের মুসলিম লীগ বা পিপলস পার্টি-তাদেরও কোটি প্রবাসী সমর্থক আছে। কিন্তু তারা বিদেশে রাজনৈতিক শাখা খোলে না।
তাদের “ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া” বা “কালচারাল ফোরাম” আছে-রাজনৈতিক ব্যানার নয়।
আমরা ব্যতিক্রম, কারণ আমাদের রাজনীতি প্রবাসীদের দেখে অর্থের উৎস হিসেবে।
ঢাকার নেতারা বিদেশে নিজের লবি গড়েন-একজন “সভাপতি”, আরেকজন “সাংগঠনিক সম্পাদক” বানিয়ে রেখে দেন।
ফলাফল: পদ-বণ্টন নিয়ে মারামারি, গালাগালি, এমনকি আদালত পর্যন্ত গড়ায় বিরোধ।
যে প্রবাসীরা ১৬ ঘণ্টা কাজ করে দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখেন, তারাই আজ লজ্জার মুখোমুখি।
তারা চান না “বাংলাদেশি” শব্দটা বিদেশে শুনলেই লোকে বলুক- “ওরা তো ঝগড়াটে জাতি।” জুলাই আন্দোলনের সময় প্রবাসীরা দলীয় ব্যানারে নয়, দেশপ্রেমে রাস্তায় নেমেছিলেন। তারা লড়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে, দলের নয়।
আজ সেই প্রবাসীদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে দলীয় স্বার্থে, চাঁদা সংগ্রহে, নেতৃত্বের ব্যবসায়।
“আজ প্রবাসী রাজনীতি মানে পদ-পদবি, চাঁদা আর চেঁচামেচির ব্যবসা। দেশ নয়, দলই এখন উদ্দেশ্য।”
ফ্রান্সে উপদেষ্টা হেনস্তা, সুইজারল্যান্ডে অধ্যাপক নজরুলকে গালাগালি, লন্ডনে বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংঘর্ষ, আর এখন নিউ ইয়র্কে ডিম ছোড়া-
এইসব ঘটনাই প্রমাণ করে, বিদেশে দলের শাখা মানে বিশৃঙ্খলার আমদানি।
একদিকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার কথা, অন্যদিকে সেই জাতিসংঘ ভবনের সামনেই নিজেদের নেতা হেনস্তা-এ কেমন আত্মবিরোধিতা?
এই অসুস্থ সংস্কৃতি ভাঙার একটাই পথ-
বিদেশে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা।
দলগুলো স্পষ্টভাবে বলুক-“বিদেশের মাটিতে আর কোনো শাখা নয়।”
প্রবাসীরা চাইলে “বাংলাদেশ ফোরাম”, “ডায়াসপোরা কাউন্সিল”, “সংস্কৃতি ও উন্নয়ন সংগঠন” গড়তে পারেন-অরাজনৈতিক, দেশকেন্দ্রিক।
তারা দেশের সংস্কৃতি প্রচার করবেন, অর্থনীতিতে অবদান রাখবেন-কিন্তু কাউকে গালি দিয়ে নয়।
সরকারেরও প্রয়োজন সাহস দেখানো।
যে দল বিদেশে আইন ভেঙে শাখা চালায়, তাদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
কারণ এটি শুধু রাজনৈতিক অপরাধ নয়, এটি রাষ্ট্রের মর্যাদার প্রশ্ন।
যদি এই ধারাবাহিকতা না থামে, তাহলে বিদেশে “বাংলাদেশ” নামটি উচ্চারিত হবে ডিম, গালি, হেনস্তা আর বিশৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে।
রাজনীতি মানে প্রতিপক্ষকে অপমান নয়-দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা।
জুলাই আন্দোলনের শিক্ষা ছিল-দল নয়, দেশ আগে।
এবারও সেই শিক্ষা প্রযোজ্য।
প্রবাসীরা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা, তারা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
তাদের নাম যেন রাজনীতির হেনস্তায় নয়, সম্মানে উচ্চারিত হয়।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত-যে দলই হোক, সবার জন্য একই নিয়ম হওয়া দরকার।
বিদেশে রাজনীতি নয়, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা।
প্রশ্ন এখন একটাই-কোনো দল কি সাহস করে বলতে পারবে: “বিদেশের মাটিতে আর কোনো শাখা নয়”?


লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
email:  niazjournalist@gmail.com

মতামত'র অন্যান্য খবর