তী র্য ক ম ন্ত ব্য

জাতীয় সনদ আইনি ভিত্তির রূপরেখা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী | মতামত
অক্টোবর ২৫, ২০২৫
জাতীয় সনদ আইনি ভিত্তির রূপরেখা

রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে জাতীয় সনদ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নের পদ্ধতি, বিশেষত গণভোট সংক্রান্ত প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে গভীর আলোচনা চলছে। গণভোটের মূল উদ্দেশ্য হবে-জাতীয় সনদের নীতি, লক্ষ্য ও দিকনির্দেশনা অনুমোদন করা এবং তা কার্যকর করার সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামো নির্ধারণে জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত প্রদান। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ‘জাতীয় সনদ অধ্যাদেশ-২৬’ জারি করে আইনি সুরক্ষা দিয়ে এই উদ্যোগ সম্পন্ন করা যায়।


এই প্রস্তাবনাটি চিলির মডেল অনুসারে ‘দ্বৈত-আইনি ম্যান্ডেট’ (Dual Legal Mandate) ধারণা গ্রহণ করে তৈরি করা হয়েছে-অর্থাৎ, একইসঙ্গে সাংবিধানিক ও আইনি-কাঠামো নির্ধারণের জন্য জনগণের অনুমোদন নিশ্চিত করা। ভোটারদের সামনে রাখা প্রশ্নগুলো এমনভাবে প্রণীত, যাতে তারা এককভাবে “হ্যাঁ” বা “না” উত্তর দিয়ে রাষ্ট্রসংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারসভা ও জাতীয় সংসদ-এই দু’টি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বকে বৈধতা দিতে পারেন।
১। সরল ও সরাসরি সংস্করণ (Simple &‌ Direct): এই প্রশ্নটি জাতীয় সনদের সামগ্রিক আইনি বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সরাসরি সম্মতি চায় এবং এই কাজের জন্য দুই সংস্থাকে অনুমোদনের ওপর জোর দেয়।
গণভোটের প্রশ্ন: জাতীয় সনদে বর্ণিত সাংবিধানিক বিষয়াবলি সংবিধান সংস্কারসভার মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যান্য বিষয় বাস্তবায়নে সংসদের দ্বারা আইনি কাঠামো নির্ধারণ-এই উভয় পদক্ষেপে কি আপনার সম্মতি আছে?”
প্রথম বিকল্প: হ্যাঁ
দ্বিতীয় বিকল্প: না


২। ম্যান্ডেট ও বাধ্যবাধকতা ভিত্তিক সংস্করণ (Mandate &‌ Obligation):
এই প্রশ্নটি গণভোটের মাধ্যমে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ওপর সাংবিধানিক ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের কর্তৃত্ব এবং বাধ্যবাধকতা-উভয় আরোপের ওপর জোর দেয়।
গণভোটের প্রশ্ন: ‘জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে-এর সাংবিধানিক বিষয়গুলো সংবিধান সংস্কারসভার মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং অবশিষ্ট বিষয়াদির জন্য সংসদের দ্বারা বিশেষ আইনি কাঠামো নির্ধারণ-উভয় পদক্ষেপ গ্রহণ কি বাধ্যতামূলকভাবে অনুমোদিত হওয়া উচিত?’
প্রথম বিকল্প: হ্যাঁ
দ্বিতীয় বিকল্প: না


৩। সুনির্দিষ্ট ও কার্যকারিতা ভিত্তিক সংস্করণ (Specific &‌ Effectiveness): এই প্রশ্নটি সনদের বিষয়বস্তুগুলোর আইনি অবস্থান ও কার্যকারিতার ওপর আলোকপাত করে এবং এই সম্মিলিত পদক্ষেপের জন্য সংস্কার সভা ও সংসদের ভূমিকার বৈধতা চায়।
গণভোটের প্রশ্ন: “জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সাংবিধানিক বিষয়াবলি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি এবং অন্যান্য নীতিসমূহের কার্যকারিতার জন্য আইনি-কাঠামো নির্ধারণ-এই সম্মিলিত সাংবিধানিক ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে এবং এই উদ্দেশ্যে সংবিধান সংস্কারসভা ও সংসদকে অনুমোদন দিতে কি আপনার সমর্থন আছে?”
প্রথম বিকল্প: হ্যাঁ
দ্বিতীয় বিকল্প: না


এই Constitution Design Proposal-এর মূল দিকসমূহ:-
১. দ্বৈত ম্যান্ডেট নিশ্চিতকরণ: ভোটার একই সঙ্গে সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য একটি বিশেষ সংস্থা (সংবিধান সংস্কারসভা) এবং বিস্তারিত আইন প্রণয়নের জন্য বিদ্যমান সংস্থা (সংসদ)- এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে সরাসরি গণম্যান্ডেট প্রদান করবেন।
২. স্পষ্টতা ও কার্যকারিতা: প্রশ্নগুলো স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে, কীভাবে (সাংবিধানিকভাবে ও আইনগতভাবে) এবং কার দ্বারা (সংস্কারসভা ও সংসদ) জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ কার্যকারিতা নিশ্চিত হবে।
৩. সরাসরি গণরায়: ভোটারকে কেবল একটি “হ্যাঁ” বা “না” উত্তর দিতে হবে, যা প্রক্রিয়াটিকে সহজ, বোধগম্য ও গণমুখী করে তোলে।
৪. জনগণ-নির্ভর বৈধতার নতুন ধারা: এই প্রস্তাব রাষ্ট্রসংস্কারের অর্থাৎ ব্যাপক সাংবিধানিক সংস্কারের বৈধতাকে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক অনুমোদন নয়, বরং জনগণের সরাসরি রায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।


জনগণের রায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের বৈধতা: জাতীয় সনদ কেবল একটি নীতিনির্ধারণী দলিল নয়-এটি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নৈতিক ও সাংবিধানিক ঘোষণা। এর বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত এই গণভোট একটি জনমুখী  ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ উবংরমহ চৎড়ঢ়ড়ংধষ, যা সরকারের হাতে নয়, বরং নাগরিকদের হাতে রাষ্ট্রসংস্কারের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়।
সংবিধান সংস্কারসভা ও জাতীয় সংসদ-এই গণরায়ের প্রতিনিধিত্বমূলক ধারক হিসেবে কাজ করবে। একটি সাংবিধানিক পরিসরে, অন্যটি আইনি পরিসরে। এভাবে, গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা আইনি রূপ নেবে, রক্তের দাবি পাবে সংবিধানিক প্রতিফলন এবং রাষ্ট্র পাবে জনগণের নতুন নৈতিক বৈধতা। 
 

লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com

মতামত'র অন্যান্য খবর