সা ফ ক থা

হাদির মৃত্যু সংবাদ ঘিরে কেন অরাজকতা?

হাসান মামুন | মতামত
ডিসেম্বর ২৪, ২০২৫
হাদির মৃত্যু সংবাদ ঘিরে কেন অরাজকতা?

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ শরীফ ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার্থে সিঙ্গাপুর পাঠানো হলেও জোরালো আশা ছিল না, তিনি সুস্থ হয়ে ফিরবেন। তার মাথায় গুপ্তঘাতকের গুলির আঘাত ছিল খুবই গুরুতর। রাজধানীর দুই হাসপাতালে হাদির যথাযথ চিকিৎসা হয়নি, সেটাও বলা যায় না। তবু প্রয়াস নেয়া হয়েছিল এমন একজন ব্যক্তির জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করার। এতেও ফল হয়নি; তার মৃত্যু সংবাদ মিললো ১৮ই ডিসেম্বর রাতে। এতে দুঃখ ও শোকের পরিবেশ আরও গভীর হবে, সেটাই স্বাভাবিক। 
 

ওসমান হাদি আক্রান্ত হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেছিলেন, এটা জুলাই আন্দোলন, গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া ও দেশের ওপর আঘাত। তার সঙ্গে দ্বিমত করবে, এমন মানুষ কমই। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানীর একটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণাও চালাচ্ছিলেন হাদি। হাসিনা সরকার পতনের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাখা তেজি ভূমিকা থেকে কিছুটা সরে এসে ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক চিন্তাভাবনা সামনে আনছিলেন তিনি। নতুন চিন্তায় বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার ওপরও জোর দিচ্ছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণায় এনেছিলেন অনুসরণযোগ্য নতুন উপাদান। কিন্তু তার টিমে যুক্ত হওয়া কিছু লোক যে গুপ্তঘাতক, সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। সুযোগ পেয়ে তারা ঠিকই ওসমান হাদির মৃত্যু নিশ্চিত করার মতো ঘৃণ্য কাজটি করে। উন্নত চিকিৎসা দিয়েও তাই হাদিকে বাঁচানো যায়নি। এটা এক বড় ক্ষতি, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। একইসঙ্গে অসহনীয় বেদনার বিষয়। 
 

ওসমান হাদির মৃত্যু সংবাদ আসার পর রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে একশ্রেণির লোক যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, সেটাও সুস্থ চিন্তার কেউ স্বাগত জানাবে না। তার ওপর নৃশংস হামলাকে পুঁজি করে অবশ্য এর আগেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা চলে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে; সমালোচনারও যথেষ্ট কারণ আছে। গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পরও ভারতের ভূমিকা বদলায়নি। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারও দেশের সিংহভাগ মানুষের অনুভূতির প্রতিফলন ঘটিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও বিভিন্ন সমাবেশ ও মিছিল থেকে; এমনকি টিভি টকশোয় যে ভাষায় বক্তব্য রাখা হচ্ছে; তা দেশের স্বার্থ কতোটা রক্ষা করছে, সেটা নিয়ে আছে প্রশ্ন। এসব অপরিণামদর্শী বক্তব্য উল্টো ক্ষমতাচ্যুতদের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে বলেও অনেকের ধারণা। এ অবস্থায় হাদির মৃত্যু সংবাদ আসার পর দেশের দু’টি সুপ্রতিষ্ঠিত মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে একদল লোক যেভাবে হামলা চালিয়েছে, তা নজিরবিহীন। কোনো গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশে এটা অকল্পনীয়। সংবাদকর্মীদের ভেতরে রেখে ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারতো। হামলা চালানো হয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি আক্রান্ত হয়েছে নতুন করে। উল্লেখ করার মতো আরেকটি ঘটনা হলো চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয় লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ। এর সামনে আয়োজিত প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন শেষে ওই ঘটনা ঘটলেও বোঝা মুশকিল, ঠিক কারা এতে জড়িত। সেখানে উপস্থিত পুলিশ দ্রুত হস্তক্ষেপ করলে অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। অভিযুক্ত কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। 
 

এদিকে রাজধানীর অরাজকতা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও সেনা সদস্যরা কিন্তু দেরি করে ফেলেছেন। ওসমান হাদির মৃত্যু সংবাদ ঘিরে একটি মহল এ ধরনের অরাজকতায় জড়িয়ে পড়তে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য কী তাদের কাছে ছিল না? প্রধান উপদেষ্টা কিন্তু হাদির মৃত্যু সংবাদ আসার কিছু সময় পরই জাতির সামনে দেয়া ভাষণে সবাইকে শান্ত থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানান। কারও পাতা ফাঁদে পা দেয়া যাবে না বলে সতর্কও করে দেন। তার মানে, সরকার উত্তেজনা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টার বিষয়ে ভালোভাবেই অবহিত। সেটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও মাত্র কয়েকশ’ লোক কীভাবে দুই মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে হামলাসহ অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারলো, তাতে অবাক হতে হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে দেরিতে হাজির হয়ে কঠোর ব্যবস্থাও নেননি। এটা কেন, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। হাদির মৃত্যু ঘিরে, জুলাইয়ের চেতনা অক্ষুণ্ন রাখার নামে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানসহ স্পর্শকাতর স্থাপনায় হামলা কী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা দেবে? এটা কী সারা দুনিয়ায় সুপরিচিত মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বিষয়ে ভালো ধারণা তৈরি করবে? সবচেয়ে বড় কথা, এসব ঘটনা কী রক্তস্নাত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের জন্য ইতিবাচক? ওই আন্দোলনে যে ‘ইনসাফ’ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জোরালো আওয়াজ তোলা হয়েছিল-এসব ঘটনা কী তারও প্রতিফলন ঘটাচ্ছে? 
 

অথচ দু’মাস পরই নির্বাচন হওয়ার কথা। এবার জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হবে একসঙ্গে। এর ভেতর দিয়ে আমরা যেমন একটি নির্বাচিত সরকার পাবো; তেমনি আছে রাষ্ট্র সংস্কারে জনগণের অভিমত পাওয়ার আশা। তফসিল ঘোষণার আগেই কিন্তু এর অনুকূল পরিবেশ তৈরির কথা ছিল। দেখা যাচ্ছে, সেটা ঘোষণার পরও পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরদিন দুপুরেই রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে আক্রান্ত হন ওসমান হাদি। হামলাকারীরা দ্রুত দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরও রয়েছে। হাদিসহ জুলাইযোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি উঠেছিল। তাদের প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়তো কঠিন। কিন্তু জুলাইযোদ্ধাদের একজন ভয়ানকভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরও সরকারকে তেমন সক্রিয় দেখা যায়নি। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। হাদির মৃত্যু সংবাদ ঘিরে মহলবিশেষ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো, তাতে এমন দাবি জোরালো হবে। হয়তো আরও কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি উঠবে। কিন্তু পদত্যাগ তো সমাধান নয়।
 

তাছাড়া নিকটেই অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। আর তফসিল ঘোষণার পর সে লক্ষ্যেই গোটা প্রশাসন বেশি করে নিয়োজিত হওয়ার কথা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কাজটি এতদিন হয়নি বলে তা আর করতে হবে না, এমন তো নয়। এ অবস্থায় সরকারে যারা আছেন, তাদের সবার দায়িত্ব যার যার অবস্থান থেকে নির্বাচন কমিশনকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা জোগানো। নতুন কাউকে উপদেষ্টা হিসেবে নেয়া হচ্ছে না, এমন খবরও আছে বাজারে। এ অবস্থায় মোক্ষম ইস্যু পেলেই মহলবিশেষ যেভাবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে; জনগণের আস্থায় ধস নামাচ্ছে, সেটা তো চলতে দেয়া যাবে না। বাইরে থেকে কিছু প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তি জুলাই আন্দোলনের মিত্র পরিচয়ে দেশে থাকা অনুসারীদের উস্কাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী কিছু লোক একদল ক্ষিপ্ত মানুষকে উস্কালেই তারা যা ইচ্ছা করতে পারবে, এটা কোনো কাজের কথা নয়। তাহলে মাঠে থাকা সব রাজনৈতিক দল ও পক্ষের সম্মতিতে দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার আছে কেন? 
 

দুই মিডিয়া প্রতিষ্ঠান নজিরবিহীনভাবে আক্রান্ত হয়েছে শুনে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল করীর ঘটনাস্থলে গেলে তাকেও ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ আখ্যা দিয়ে হেনস্তা করা হয়। এ পর্যন্ত নূরুল কবীরের ভূমিকা তো কারও অজানা থাকার কথা নয়। দায়িত্বপূর্ণ ও আপসহীন ভূমিকার কারণে শেখ হাসিনার বিগত শাসনামলেও তিনি হয়েছিলেন অব্যাহত হুমকি ও নিগ্রহের শিকার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তিনি সাংবাদিকসুলভ বলিষ্ঠ ভূমিকায় রয়েছেন। তা সত্ত্বেও অরাজকতার পক্ষে না থাকায় তিনিও এখন আক্রান্ত! 
 

জুলাই জারি রাখার নামে যারা এভাবে প্রচলিত আইন ও সভ্য সমাজের রীতিনীতি ভেঙে চলেছে, তাদের হাতে কোনো কিছু গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায় না। নিজ পছন্দের বাইরে কোনো কিছু টিকে থাকতে দেবে না বলে তারা যে ঘোষণা দিচ্ছে বারবার, সেটাও কার্যত ফ্যাসিবাদের ধারাবাহিকতা। চিন্তা দিয়েই যে চিন্তাকে মোকাবিলা করতে হয়, এ বিষয়েও তাদের জ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। অব্যাহত মব আর পরিকল্পিত হামলা করে তারা কার্যত গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়াই ব্যাহত করছে। গণতন্ত্রে উত্তরণ না হলে তো রাষ্ট্র সংস্কারের দীর্ঘ আলোচনাও কোনো কাজে আসবে না। সেটা হয়ে থাকবে মূল্যবান সময়ের অপচয়। 
 

এ অবস্থায় দেশ অধিকতর সংকটের দিকে যাত্রা করতে পারে, যা শান্তি ও স্থিতির জন্য অপেক্ষমাণ জনতার কাম্য নয়। নাজুক অর্থনীতিরও ক্ষমতা নেই এটা সহ্য করার। গণ-অভ্যুত্থানের নামে অব্যাহত অরাজকতার পথে থাকা মহলটি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশকে সংকটে ফেলছে কিনা, সেটা চিন্তা করে পদক্ষেপ নেয়ারও সময় এসে গেছে। ্ত
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
 

মতামত'র অন্যান্য খবর