ওসমান হাদি-একটি নাম, যা এখন আর কেবল একজন রক্ত-মাংসের মানুষের পরিচয় নয়; বরং বাংলাদেশের রাজপথের এক অনিবার্য সেনাপতির নাম। তার চিরপ্রস্থান কেবল একটি জীবনের পরিসমাপ্তি নয়, বরং লড়াইয়ের পুনর্জন্ম। যে-কণ্ঠস্বর একসময় কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রতিটি ছত্রে বিপ্লবের স্পর্ধা ছড়িয়ে দিতো, সেই কণ্ঠ আজ কবির সান্নিধ্যেই চিরশান্তিতে মগ্ন। জাতীয় কবির পাশে তার এই অন্তিম শয়ান কেবল একটি দাফন নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক মিলনমেলা; যা এই বার্তাই দেয় যে-বিদ্রোহ আর সাম্যের চেতনা কখনো মরে না। ইতিহাসের এক অমোঘ নিয়তিতে শাসিত হয়ে, নজরুলের দ্রোহের মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতেই তিনি আজ মিশে গেছেন সেই দ্রোহের জনকের পাশে, যেনো এক বিপ্লবী সত্তা ফিরে পেয়েছে তার চিরন্তন উৎসকে।
সাহস ও উপস্থিতির রাজনীতি
জুলাই অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে যখন ভয়, অনিশ্চয়তা ও দমন-পীড়নের পরিবেশ রাজপথকে নিস্তব্ধ করতে চেয়েছিল, ওসমান হাদি সেখানে দৃশ্যমান ছিলেন। তার সাহস কোনো হঠাৎ আবেগের ফল ছিল না; বরং তা ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ। তিনি জানতেন, প্রতিবাদের পথ ঝুঁকিপূর্ণ, তবুও তিনি সেই পথ থেকে সরে দাঁড়াননি। ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষু, অন্যায়ের আস্ফালন আর হত্যাকাণ্ডের নির্মমতার বিরুদ্ধে তার যে-লড়াকু মানসিকতা-তা তাকে কেবল একজন আন্দোলনকারী নয়, বরং একটি সাহসী প্রতীকে পরিণত করেছে। মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তিনি যে-স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য কাব্য হয়ে থাকবে।
সত্যের প্রশ্নে আপসহীনতা
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে ওসমান হাদি কেবল রাজনীতি করেননি, বরং তিনি ছিলেন অবদমিত গণমানুষের আর্তনাদ ও অনুভূতির এক জীবন্ত অনুবাদক। আধিপত্যবাদ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল হিমালয়সম অটল ও অবিচল। সত্যের প্রশ্নে তিনি কখনো কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে মাথানত করেননি; বরং চরম প্রতিকূলতায়ও নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা রেখেছিলেন। নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও তিনি মিথ্যার সঙ্গে কোনো আপস করেননি, কারণ তার কাছে আদর্শ ছিল জীবনের চেয়েও দামি।
চিন্তা ও দর্শনের দিকনির্দেশ
ওসমান হাদি প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার ওপর চরম বিরক্ত ও আস্থাহীন ছিলেন; আর এই অনাস্থা থেকেই জন্মেছিল এক আমূল পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন, মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে উঠে আসা সেই লড়াকু তরুণদের ওপর, যারা কোনো ব্যক্তিস্বার্থ নয় বরং দেশপ্রেমের তাড়নায় রাজপথে নামে। তার রাজনীতি ছিল আধিপত্যবাদের শঙ্কার বিরুদ্ধে অটল এক দেয়াল এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি আসা যেকোনো হুমকির বিরুদ্ধে এক বজ্রকঠিন প্রত্যয়।
জুলাই বিপ্লবের প্রতি তার অকৃত্রিম সহমর্মিতা ও সংহতি কেবল মৌখিক ছিল না, বরং তা ছিল তার সত্তার অংশ। ওসমান হাদি এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে ধর্মীয় মধ্যপন্থা হবে সামাজিক শান্তির মূলভিত্তি এবং যেখানে নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির কোনো স্থান থাকবে না। ইনকিলাব মঞ্চের মাধ্যমে তিনি সেই জনঘৃণিত ব্যবস্থার বিলোপ চেয়েছেন। ধর্মীয় মধ্যপন্থা, অর্থ ও পেশিশক্তিমুক্ত নির্বাচন এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে তার অবস্থান তাকে অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে, আবার কারও কাছে প্রশ্নবিদ্ধও করেছে। এই দ্বৈত প্রতিক্রিয়াই তার রাজনীতির বাস্তবতা।
মতাদর্শের বাইরে জনসম্পৃক্ততা
ওসমান হাদির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তার সর্বজনীন উপস্থিতি। তার রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে অনেকের দ্বিমত থাকলেও, জনগণের অধিকারের প্রশ্নে তার সততা দৃষ্টান্তমূলক। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন অনেক সাধারণ মানুষ সেখানে নিজেদের অনুভূতির প্রতিধ্বনি খুঁজে পেতো। তিনি কোনো একক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে থাকেননি; বরং বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এই কারণেই তিনি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন, বরং একটি সময়ের জনসম্পৃক্ত কণ্ঠ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
শোক থেকে স্মৃতি, স্মৃতি থেকে দায়
সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ পর্যন্ত যে-জনসমাগম দেখা গেছে, তা শুধু একটি জানাজার আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এটি ছিল মানুষের আবেগ, স্মৃতি ও প্রত্যাশার সম্মিলন। মানুষ সেখানে কেবল একজনকে বিদায় জানাতে আসেনি; এসেছে একটি সময়কে স্মরণ করতে। এই উপস্থিতি দেখিয়ে দেয়-ওসমান হাদির রাজনীতি অনেক মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তার মৃত্যু শোকের পাশাপাশি প্রশ্নও রেখে যায়-এই সাহস, এই কণ্ঠ, এই প্রতিবাদকে সামনে কে বহন করবে?
তিনি আজ কোনো নির্দিষ্ট দলের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নন, বরং তিনি হয়ে উঠেছেন মুক্তিকামী মানুষের অভিন্ন মানচিত্র। যতদিন এই জনপদের মানুষ সাম্য, মানবিকমর্যাদা, সামাজিকসুবিচার আর স্বাধীনতার অপূর্ণ স্বাদ পেতে চাইবে, যতদিন শোষণের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠবে, ততদিন ওসমান হাদি আমাদের লড়াইয়ের প্রেরণা ও রাজপথের আলোকবর্তিকা হয়ে বেঁচে থাকবেন। রক্ত-মাংসের মানুষটি সমাহিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া ‘সংগ্রামী স্পর্ধা’র কখনো মৃত্যু নেই।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com