বিগত ষোলো বছর রাজনৈতিক সংস্কৃতি একদম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তখন ছিল ফ্যাসিবাদী শাসন, সীমাহীন নির্যাতন, নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের এক দীর্ঘ কালো অধ্যায়। এই সময়ে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একটি বিস্তৃত কারাগারে পরিণত হয়েছিল, যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল বিপন্ন, ভোটাধিকার ছিল হরণকৃত এবং মানবাধিকার ছিল বারবার পদদলিত। গুম, খুন, হামলা, মামলা, কারাবরণ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেশের রাজনীতিকে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও রিজার্ভ চুরির মতো ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়, যা রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে তোলে এবং জনগণের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
এই দুঃসময়ে যে রাজনৈতিক দলটি সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেই দলটি হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। সংখ্যার হিসাব নয়, বাস্তবতার নিরিখেই বলা যায়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বিএনপিকে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূলের সাধারণ কর্মী পর্যন্ত কেউই রেহাই পাননি। গুম, খুন, হামলা ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মীর নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলাই প্রমাণ করে, স্বৈরাচারী শাসনের প্রধান টার্গেট ছিল বিএনপি। সামপ্রতিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যায় সেই নির্মম বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটেছে।
এই দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিলেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করলেও আন্দোলনের নৈতিক ও কৌশলগত নেতৃত্ব দিয়েছেন অবিচলভাবে। দেশের সকল মত ও পথের গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক শক্তিকে একীভূত করে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করেছেন এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইকে একদফার দাবিতে কেন্দ্রীভূত করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, একদফার আন্দোলনের ডাক সবার আগে দিয়েছিলেন তারেক রহমানই, যা পরবর্তীতে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং স্বৈরশাসনের পতনের পথ সুগম করে।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক উত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, কিংবা কেবল পারিবারিক পরিচয়ের ফলও নয়; এটি তৃণমূল থেকে গড়ে ওঠা দীর্ঘ ও শ্রমসাধ্য পথচলার ফসল। ১৯৮৮ সালে তিনি গাবতলী উপজেলার সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে। সেই সময় থেকেই তিনি রাজনীতিকে দেখেছেন মাঠের ভেতর থেকে, মানুষের কাতার থেকে। বারবার তৃণমূলের কাছে ছুটে গেছেন গ্রাম, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে সংগঠনের ভিত শক্ত করতে এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আশা-আকাঙ্ক্ষা সরাসরি জানতে। এই তৃণমূলমুখী রাজনীতিই তাকে মানুষের কাছাকাছি এনে দিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তারেক রহমান কখনো কোনো রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হননি। ক্ষমতার চেয়ার নয়, বরং জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই ছিল তার রাজনৈতিক ব্রত। এই অবস্থান তাকে একজন ভিন্নধারার রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যিনি ক্ষমতার সুবিধাভোগী না হয়ে আন্দোলনের রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণের রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তৃণমূলের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দূরদর্শী নীতি ও পরিকল্পনার কথা ভেবেছেন।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের আরেকটি বড় দিক হলো তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা চিন্তা। আজ যখন দেশ জুড়ে পেপাল চালুর দাবি উচ্চারিত হচ্ছে, তখন স্মরণ করা প্রয়োজন যে, ২০১৩ সালেই তিনি বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্ত হওয়ার জন্য পেপালের অপরিহার্যতার কথা বলেছিলেন। আজ রাষ্ট্র সংস্কার যখন জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে, তখন ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বৈরাচারের দুঃসময়েই বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছিল। কৃষিকে রপ্তানিমুখী করা, খাল খননের মাধ্যমে কৃষি ও পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা, ব্যাপক বৃক্ষরোপণ এবং নারীর ক্ষমতায়ন-এসবই ছিল তার দীর্ঘমেয়াদি ভাবনার অংশ।
নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে তারেক রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বাস্তবভিত্তিক ও মানবিক। পরিবারের নারী সদস্যদের নামে ফ্যামিলি কার্ড ইস্যুর চিন্তার মাধ্যমে তিনি নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার পথে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেখানে নারীদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যেখানে নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেখানে তারেক রহমান চেয়েছেন শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী মা গড়ে তুলে পরিবারকে শক্তিশালী করতে, আর সেই শক্তিশালী পরিবার থেকেই গড়ে উঠবে শক্তিশালী রাষ্ট্র।
কোটা সংস্কারের প্রশ্নে তার অবস্থান ছিল সময়ের অনেক আগেই নির্ধারিত। ২০১৪ সালেই তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য কোটার পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। আজকের বাস্তবতা প্রমাণ করে, সেই বক্তব্য কতোটা দূরদর্শী ও প্রাসঙ্গিক ছিল। এই অগ্রসর চিন্তার কারণেই হয়তো তাকে বারবার রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে তার কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে, যেন তার ভাবনা জনগণের কাছে পৌঁছাতে না পারে।
তবে ইতিহাস বলছে, শত চেষ্টার পরেও তারেক রহমানকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি’র রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক ভূমিকা-১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার ঘোষকের দল হিসেবে, ১৯৭৫ সালে সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয় সংহতির আদর্শ ধারণ করে, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে এবং ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বিএনপি প্রতিটি সংকটে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। শহীদ জিয়া থেকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হয়ে বর্তমানে তারেক রহমান-এই ধারাবাহিকতা একটি রাজনৈতিক দর্শনের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার।
আজ বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই পথ সহজ নয়; চড়াই-উতরাই পেরোতে হবে, নানা ষড়যন্ত্র ও বাধা মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু এই বাস্তবতায় দেশের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক নাম তারেক রহমান। দীর্ঘ প্রবাসজীবনের অবসান ঘটিয়ে তার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় দেশের মানুষ। তার আগমন হবে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের বার্তা, ভয়মুক্ত রাজনীতির সূচনা এবং আগামীর বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন অধ্যায়। যে মুহূর্তে তারেক রহমান এই দেশের মাটিতে পা রাখবেন, ঠিক তখনই বাংলাদেশের ইতিহাসে শুরু হবে নতুন এক অধ্যায়, সেটি হবে মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার দিন, জমে থাকা বেদনা ও আবেগের বাঁধ ভেঙে পড়ার ক্ষণ।
‘সবার আগে বাংলাদেশ’ স্লোগানটি হয়ে উঠবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অনুভূত এক বাস্তব সত্য। নেতৃত্ব আর জনতার মাঝে যে দূরত্ব একসময় তৈরি হয়েছিল, তা মিলিয়ে যাবে বিশ্বাস, আস্থা ও নিখাদ ভালোবাসার অদৃশ্য সেতুবন্ধনে। সেদিন রাস্তায় মানুষের ঢল নামবে শুধু দেখার তাড়নায় নয়, হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষায়; মাইলের পর মাইল পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের চোখে থাকবে জল, কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হবে দৃপ্ত ঘোষণা, বুকভরা থাকবে উচ্ছ্বাস আর প্রত্যাশা। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য তারেক রহমান একটা স্লোগান দিয়েছিলেন- ‘টেইক ব্যাক বাংলাদেশ।’
এই প্রত্যাবর্তন কেবল একজন নেতার দেশে ফেরা নয়, এটি হবে দমে যাওয়া স্বপ্নগুলোর পুনর্জন্ম, নিঃশব্দ কান্নার ভাষা পাওয়া এবং দীর্ঘ অন্ধকার পেরিয়ে আলোর দিকে ফিরে তাকানোর সাহস। যে মায়েরা সন্তানের ছবি বুকে চেপে ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় থেকেছেন, যে তরুণেরা ভবিষ্যৎ হারানোর ভয়ে নিঃশ্বাস আটকে রেখেছেন, যে মানুষগুলো ভোটের কাগজে নিজের কণ্ঠ খুঁজে পাননি, সবার চোখেই সেদিন একসঙ্গে জ্বলবে আশা। ইতিহাসের ক্লান্ত পাতাগুলো উল্টে নতুন অধ্যায়ের প্রথম লাইনে লেখা থাকবে মানবিকতা, ন্যায় ও গণতন্ত্রের অঙ্গীকার। অশ্রু আর উল্লাস এক হয়ে আকাশে ভাসবে, হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসবে একটিই শপথ, আর কখনো অন্ধকার নয়।
এই দেশ আবার কথা বলবে, মানুষ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, আর গণতন্ত্র ফিরে পাবে তার আপন ঘর। সেই দিনটি শুধু একটি তারিখ হবে না, সেটি হবে একটি জাতির আত্মার জেগে ওঠার দিন, ভালোবাসা ও বিশ্বাসে গড়া নতুন বাংলাদেশের জন্মক্ষণ।
লেখক: বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা