পার্শ্ব ভাবনা

লন্ডন টু ঢাকা, পরের যত চ্যালেঞ্জ

খায়রুল আনোয়ার | মতামত
ডিসেম্বর ২৪, ২০২৫
লন্ডন টু ঢাকা, পরের যত চ্যালেঞ্জ

অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনা, গুঞ্জন-গুজব পেছনে ফেলে দেশে ফিরছেন তারেক রহমান। সুদীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ২৫শে ডিসেম্বর লন্ডন থেকে ঢাকার বুকে নামবেন। তাকে স্বাগত জানাতে দলের লাখো নেতাকর্মী, সমর্থক অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। দল থেকে বলা হচ্ছে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের খবরে আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত নেতাকর্মীদের বাঁধ ভাঙা জোয়ারে সেদিন রাজধানী ঢাকায় জনস্রোত তৈরি হবে। তারেক রহমানের অভ্যর্থনায় ব্যাপক আয়োজন করছে বিএনপি। দল থেকে জানানো হয়েছে, স্মরণকালের সেরা সংবর্ধনা দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বৈঠকের পর বৈঠক হচ্ছে। গঠন করা হয়েছে অভ্যর্থনা কমিটি। যদিও দল থেকে এ কথাও বলা হচ্ছে, বিমানবন্দর থেকে গন্তব্য পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানানো হবে। ইতিমধ্যেই তারেক রহমানের জন্য গুলশান এভিনিউতে বাসভবন প্রস্তুত করা হয়েছে। যার অবস্থান বিএনপি’র চেয়ারপারসন তার মা বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন ‘ফিরোজা’র একেবারেই কাছাকাছি। গুলশানে পৃথক কার্যালয় তৈরি হচ্ছে, যেখান থেকে আসন্ন নির্বাচনের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কেনা হয়েছে বুলেটপ্রুফ গাড়ি। দেশে ফিরলে তারেক রহমানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে। একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকির বিষয় বিবেচনায় সরকারের কাছেও তার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে।  
 

এ দৃশ্যপটের বিপরীত চিত্র হচ্ছে, তারেক রহমান দেশে ফিরে অজস্র চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। অবশ্য গত ১৭ বছর চ্যালেঞ্জ নিয়েই তাকে নির্বাসনে থাকতে হয়েছে। ১/১১’র সেনাসমর্থিত সরকারের সময় কতিপয় সেনাসদস্যের দ্বারা নিদারুণ শারীরিক নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন বহন করে তাকে দেশ ছাড়তে হয়। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্যমূলক মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। করোনার সময় সাজা স্থগিত করে অন্তর্বর্তী জামিন দিয়ে তাকে গুলশানের বাসভবনে থাকার অনুমতি দেয়া হয়। কার্যত বাসভবনে তিনি অন্তরীণ ছিলেন বলা যায়। বিএনপি’র মতো একটি বৃহৎ দল পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাসিত তারেক রহমানের উপরেই বর্তায়। তখন মামলা, হামলায় জর্জরিত দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী। অনেকেই ঘরবাড়িছাড়া। দলের মহাসচিব ছাড়া স্থায়ী কমিটির প্রায় সকল নেতাকেই একাধিকবার কারাগারে পাঠায় সরকার। সরকার ও তার গোয়েন্দা সংস্থা বিএনপি ভাঙার জন্য নানারকম তৎপরতা চালায়। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ‘আমি-ডামি’র নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর জন্য যথেষ্ট তৎপর ছিল সরকার। তবে সরকারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। নানারকম প্রতিকূল পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নির্বাসনে থেকে তারেক রহমান দলের ঐক্য ধরে রাখতে সক্ষম হন। বলা যায়, শেখ হাসিনার ‘রেজিমে’ দলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাবার প্রধান দাবিদার করতে পারার চ্যালেঞ্জে তারেক রহমান ভালোভাবেই উতরে গেছেন। 
 

তবে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাকে পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মনোনয়ন নিয়ে ১৯টির মতো আসনে বিরোধের অবসান ঘটানো, এখনো আসন ঘোষণা না হওয়ায় চটে থাকা সমমনা ও শরিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানো, নির্বাচনী রণকৌশল নির্ধারণ এবং প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করা হবে তার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিএনপি দুই দফায় ২৭২টি আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। প্রথম দফায় ১৩৬টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণার পর কয়েকটি আসনে বঞ্চিতদের কর্মী- সমর্থকরা সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। দ্বিতীয় দফায় আরও ১৩৬ আসনের তালিকা ঘোষণার পর নতুন করে আরও কয়েক আসনে বিরোধ দেখা দেয়। মনোনয়ন ঘোষিত ২৭২ আসনের মধ্যে ১৯টি আসনে বর্তমানে বিরোধ বিরাজ করছে। নিরাপত্তার শঙ্কায় নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে দলের প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদ সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি এ ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছেন, নিরাপত্তা সংকট ও পারিবারিক চাপে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 
 

তারেক রহমান গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই বলে আসছেন, স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের সঙ্গী সমমনা ও শরিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করবেন। জয়লাভ করলে সবাইকে নিয়ে গঠন করবেন জাতীয় সরকার। এই লেখা পর্যন্ত শরিক ও সমমনা দলগুলোকে  কোনো আসন ছাড় দেয়া হয়নি। এ নিয়ে মিত্রদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক একটি দৈনিককে বলেছেন, বিএনপি তীরে এসে তরী ডুবাতে চাচ্ছে। বিএনপি’র দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধুদের যেভাবে বেকার ও আধা বেকার করে দুইধাপে আসন ঘোষণা করেছে, এটা আমাদের সংক্ষুব্ধ করেছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, বিএনপি একলা চলো নীতি গ্রহণ করেছে। জামায়াত যেখানে বন্ধু বাড়াচ্ছে, সেখানে বিএনপি মিত্রদের ছেঁটে ফেলছে। এটি পুরোপুরি একটি আত্মঘাতী জায়গা (সমকাল:১১ই ডিসেম্বর)। মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতা এরমধ্যে সেরে ফেলা হবে, নাকি তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর তার উপর ছেড়ে দেয়া হবে তা দেখার বিষয়। 
 

তারেক রহমানের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হবে, দলের তৃণমূল পর্যায়ে পুরোপুরি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। অনেক জায়গায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরেই এই অভিযোগ ব্যাপকভাবে সামনে চলে আসে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হতে থাকে। দলের হাইকমান্ড এতে বিব্রত হয়। সাত হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কার সহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে এদের অনেককেই আবার দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। 
 

তারেক রহমান দেশে ফেরার পর নির্বাচনের জন্য মাত্র দেড়মাস সময় পাবেন। তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে, রণকৌশল নির্ধারণ করে নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে পুরোপুরি প্রস্তুত করা। নিজে নির্বাচনী গণসংযোগে নেমে পড়া। তবে সব চ্যালেঞ্জ ছাড়িয়ে ১২ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে নিশ্চিত করে দেড় যুগ পর বিএনপিকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়াই হবে তার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। ্ত 
লেখক: কলামিস্ট
 

মতামত'র অন্যান্য খবর